সোমবার,১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

গর্বিত জাতির কলঙ্কময় অধ্যায়ঃ ১৫ই আগস্ট

গর্বিত জাতির কলঙ্কময় অধ্যায়ঃ১৫ই আগস্ট

  ———— বিশ্বজিত বড়ুয়া

১৫ই আগস্টের কথা মনে উঠলে বুক ধুক্ করে ওঠে। যে মানুষটা বাংলার অধিকার আদায় করতে প্রায় অর্ধেক জীবন কারাবরণ করেন এবং স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁকেই আমরা বাঙ্গালিরাই হত্যা করলাম? আমাদের জাতির পিতাকে আমরাই হত্যা করলাম? আমরা তো আত্মঘাতী ছাড়া আর কিছুই নয়, আমরা স্বার্থের জন্য যে কোনো সময় যে কোনো কিছু করতে পারি, তাই নয় কী? আমাদেরকে সভ্য সমাজ কী বলতে পারে? আর বললেও তাঁদের মুখে আঠা দেওয়ার মত আমাদের কিছু কী আছে?

যেমনঃ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পশ্চিম জার্মানির নোবেল বিজয়ী নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, “মুজিবকে হত্যার পর বাঙ্গালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে”।

ব্রিটিশ নাগরিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ চন্দ্র চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, “বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতি চরিত্রই তুলে ধরেছে”।

১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালের ভোরে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। তারা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধুদেরও হত্যা করে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পিছনে দেশী-বিদেশীদের অনেক কিসিঞ্জারী চাল ছিল। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোস্তাকের নাম মুখে আনতেও প্রচন্ড ঘেন্না হয়।

সিরাজদ্দৌলা পতনের কারণ হিসেবে ঘসেটি বেগম, মীর জাফরের নাম উল্লেখযোগ্য তারও নেপথ্য ছিল লর্ড-ক্লাভ। তারপর প্রায় দু’শ বছর গোলামি করে গেলাম, চরম ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্যদিয়ে পাক-ভারতকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হলো কিন্তু তাতেও সুকৌশলে রেখেগেছে চক্রান্তের গূঢ়জাল। ১২০০ মাইল দূরে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে এক করে দিলো, যেখানে সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। তারপর থেকে শুরু হলো পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের শাসন শোষণ। অদম্য বাঙ্গালীকে আবারও প্রতিবাদ/ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করা হল। তারপরের ঘটনা অনেকেরই জানা, তবুও কিছু কিছু বলতে হয় যাঁদের এখনো অজানা। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা। এতে শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করে, বাঙ্গালীর আন্দোলনকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দিতে নতুন করে দেয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের কারণে ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েও নির্বাচিতদের ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এর ভাষণের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালি এক হয়, ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে আনে লাল সবুজের পতাকা। এই লাল সবুজের পতাকার বিনিময়ে আমাদের ত্যাগ করতে হয়েছিল ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণ আর ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জ্বত। তাতেও আমাদের দুঃখ ছিল না, আমরা সব মেনে নিয়েছি। ২ লক্ষ মা-বোনের মধ্যে যাঁরা জীবিত ছিলেন সবাই সুখে দুঃখে সংসার করছিল। যুদ্ধবিধস্ত লাল সবুজের পতাকার স্বাধীনদেশ বাংলাদেশ যখন নতুন করে গঠনের কাজ চলছিল তখনও আরম্ভ হয় নতুন ষড়যন্ত্র। যেহেতু যুদ্ধের কারণে রাস্তা-ঘাট, সেতু, কল-কারখানা সবই বিধস্ত, আবার খাদ্যেরও যথেষ্ট অভাব, সেহেতু রাষ্ট্র চিন্তা করে সবার আগে খাদ্যের প্রয়োজন, তাই কয়েকটি দেশের সাথে খাদ্য চুক্তি করে। এই সুযোগে বাজপাখির চোখ পড়ে বাংলার ভূখন্ডের উপর। খাদ্যের বিনিময়ে নিতে চায় বাংলার একমাত্র প্রবাল-দ্বীপ সেন্টমার্টিন। জাতির পিতা সেন্টমার্টিন দ্বীপ দিতে রাজি না হলে ফিরিয়ে দেয় খাদ্য জাহাজ। বঙ্গোপসাগরে খাদ্য ফেলে দিয়ে খালি জাহাজ ফিরে যায় আমেরিকাতে। তাদের সাথে যোগ দেয় বাংলার পরাজিত শক্তি। তাদের মদদে শত-শত বস্তা গোডাউনের লবণ, চাউল কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়। ফলে ১৯৭৪ সালে হয় চরম দুর্ভিক্ষ। দোষ দেওয়া হয় জাতির পিতাকে। সেন্টমার্টিন দ্বীপই হল জাতির পিতার কাল, কতিপয় বিপদগামী সেনা-সদস্য দিয়ে হত্যা করা হয় সপরিবারে জাতির পিতাকে। তারপরের ঘটনা সবার সম্মুখে দিনের আলোর মত জ্বলজ্বল করছে। চলে ক্ষমতার লড়াই, ক্যু’র পরে ক্যু বুদ্ধিমান সেনাপতি টিকে যায় এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, একে একে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের। সামান্য মেজর থেকে নানান চক্রান্তের মাধ্যমে বনে যান রাষ্ট্রনায়ক তিনি আর কেহ নন, তিনি মেজর জিয়াউর রহমান। অতঃপর একে একে ফিরিয়ে আনেন যুদ্ধাপরাধীদের এবং সপরিবারে জাতির পিতা হত্যাকারীদের। তাদের প্রতিষ্ঠিত করা হয় রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, কেউ হয় রাষ্ট্রদূত, কেউ বা মন্ত্রী। যুদ্ধাপরাধীদের বাংলার মাটিতে রাজনীতি করার সুযোগ করিয়ে দেয়। সংবিধানের মূলস্তম্ভকে করে কুঠারাঘাত। শাহ্‌ আজিজ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনতার বিপক্ষে জাতিসংঘ-এ পাকিস্তানের হয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। সেই শাহ্‌ আজিজকে জিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়। বিশিষ্ট রাজাকার মৌলানা মান্নানকে মন্ত্রী বানানো হয়। তারা মন্ত্রী হয়ে জাতীয় পতাকা নিয়ে বীরদর্পে পবিত্র সংসদে প্রবেশ করেন। পরে আরও অনেকে। এরশাদ সরকারও জিয়া সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। তাদের দম্ভে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল কোণঠাসা। কিন্তু যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান জাতির পিতার কন্যা জননেত্রী তথা দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে জীবনবাজি রেখে বিচারের মাধ্যমে জাতির পিতার হত্যাকারীদের ফাঁসির মঞ্চে তুলেছেন। জাতি হয়েছে কলঙ্কমুক্ত। আশা করি বাকীরাও রেহাই পাবে না। তবে ভুলে গেলে চলবে না, আমেরিকা, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। তারা কখনো আমাদের দেশের বন্ধু হতে পারে না, যা করে শুধু স্বার্থের জন্য করে। আরও মনে রাখতে হবে, বাজপাখি যতই উপরে উঠুক না কেন, তাদের চোখ কিন্তু সব সময় সেন্টমার্টিন দ্বীপ-এর উপর রয়েছে, যে কোনো সময় আবার কালো থাবা মারতে পারে। তাই আমাদেরকে সব সময় সজাগ থাকতে হবে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ-এর সুচাগ্র মেদিনি কাউকে দেওয়া হবে না, এটা আমাদের শেষ কথা।

আগামী ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকী, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দিবসটি পালন করবে।

যতদিন রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী-যমুনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email