
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড এবং দুঃসময়ের দিনলিপি
বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ
বাঙালি জাতির একমাত্র নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের ইতিহাসে একক নেতৃত্বে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে। দ্বি-জাতির তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি, পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠির ২৪ বছরের শাসনকাল শোষণ-বঞ্চনা, নির্যাতন, বৈষম্য অবহেলা ছাড়া বাঙালিরা কিছুই পায়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শুরু করে প্রতিনিয়িত বাঙালি জাতির নেতা বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে নির্যাতন ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়তে হয়েছে বার বার। দীর্ঘকাল কারাভোগের পরও মুজিবকে দমাতে পারেনি পাকিস্তান সরকার। ‘৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু মুজিব একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি ইয়াহিয়া। তিনি ৭ মার্চের দিকনির্দেশনামূলক রেসকোর্সে ভাষণ দেন। এই ভাষণই বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামের দিকদর্শন। ২৫ মার্চ কালোরাত্রিতে বাঙালির উপর পাক বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ভেতর দিয়ে জেগে উঠে নতুন সূর্য।
‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’’ এ আহ্বান বাস্তবায়নের জন্য জাতি প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। গ্রামে গঞ্জে, কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ, ছাত্র যুবকেরা ঐক্যবদ্ধ হতে লাগলো। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মোকাবেলার জন্য যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা শুরু হলো। ব্যাপক গণহত্যার কারণে দলে দলে বিভিন্ন শ্রেণিষ-পেশার মানুষ ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করেছে। নয় মাসের যুদ্ধের পাকবাহিনীকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করেছে। জাতির জনক ১০ জানুয়ারি’৭২ পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে এলেন।
দেশের স্বাধীনতার পর মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে দেশে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হলো। মার্কিনীদের ষড়যন্ত্রের দেশে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়া। এরিমধ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মধ্যে আ স ম আবদুর রব, শাহাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ভেঙে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে দেশের আরো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। জাসদ গণবাহিনী গঠন করে, পাশাপাশি দেশী বিদেশী চক্রান্তকারীরা ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালাতে শুরু করে। সরকার পতনের আন্দোলন করে গণবাহিনীর নামে দেশে চলে ব্যাংক ডাকাতি, নানা প্রকার অরাজকতা সহিংসতা, খুন-খারাপি, পাঠের গুমামে আগুন, রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যা থেকে শুরু করে সব ধরণের অপরাধ ঘটতে থাকে। প্রতিক্রিয়াশীদের সাথে হাত মিলায় দেশীয় পরাজিত শক্তি। নানাভাবে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে। এভাবে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারীদের নিরবিচ্ছিন্ন তৎপরতার কারণে বঙ্গবন্ধু মূলত অসহায় হয়ে পড়েন। এমনি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ভেতর লুকিয়ে থাকা মোস্তাকের নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ও বিপদগামী সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে জাতির জনক তার প্রিয় মাতৃভূমিতে ঘাতকের হাতে সপরিবারে জীবন দান করেন।
১৫ আগস্ট সকালবেলা আমাদের গ্রামের পাশে ঘোষের হাটে গিয়ে শুনি বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। কথাটা বিশ্বাস হলো না। দৌড়ে পটিয়া গেলাম। থানার মোড়ে গিয়ে দেখা গেলো দোকান পাট বন্ধ তখন নিশ্চিত হলাম, বঙ্গবন্ধু আর নেই। মন খারাপ, কি করি। কোথায় যাই? কিছু নেতা-কর্মীর সাথে যোগাযোগ করলাম সবাই বলে অপেক্ষা করো দেখো কি হয়!
রেডিওতে নতুন নতুন ফরমান জারি করছে মেজর ডালিম, ফারুক-রশিদ চক্র। আগস্ট মাসের শেষে দিকে ক্ষমতা দখলকারী বাহিনী পটিয়ায় ঘাঁটি করে। তারা ধারণা করেছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবকে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ যুদ্ধে নামতে পারে। তাই, তারা উপজেলায় উপজেলায় ঘাঁটি করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে গ্রেফতার করে জেলে দেয়। হত্যা করা শুরু করে। পটিয়ায় তাদের হাতে খুন হন দোহাজারীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের। এমনি সময়ে আমার বাড়িতে কয়েক বার এসেছে তারা আমাকে পায়নি। পরে সেনা সদস্যরা বলে যায়, ২০ সেপ্টেম্ব সেনাক্যাম্পে হাজির হতে।
এ খরব পার্টি নেতারা জানতে পেরে আমাদের নেতা আবদুস সালাম মাস্টারকে বলে দেয়া হয় যাতে আমাকে আত্মাগোপনে রাখা হয়। নির্দেশ মতো আমাকে প্রথমে গৈড়ালা স্কুলের শিক্ষক বাবু বিনয় ভূষণ বড়–য়ার বাড়ীতে গোপনে রাখা হয়, কর্তলা গ্রামে।
সেখানে কিছুদিন আত্মাগোপন থাকার পর নিয়ে যাওয়া হয় কাজীর দেউরী একটি মেসে। সেখানে থাকতো আমাদের গ্রামের মৃদুল বড়–য়া। মেসে কিছুদিন থাকার পর আমাদের নেতা খুরশিদুল ইসলাম নিয়ে গেলে পাঠানটুলী এক শ্রমিক নেতার বাড়ীতে তার নাম সাইফুল ইসলাম। কাজ করতেন পতেঙ্গা স্টীল মিলে। সেখানে বেশ কয়েক মাস থাকার পর সাবেক ছাত্রনেতা আউয়াল ভাই (পরে তিনি সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন) নিয়ে গেলেন পতেঙ্গা স্টীল মিল কলোনীতে সেখানে শ্রমিক নেতা শরীফ ভাইয়ের বাসায় কয়েক মাস থাকার পর রাঙ্গুনিয়া এম.পি ইউছুপ ভাই কাজী নুরুল আবছার, মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার মাস্টার নিয়ে গেলে রাঙ্গুনিয়া কোদালা গ্রামে। সেখানে কোদালা চা বাগানে এবং আবুল কালাম ভাইয়ের বাড়িতে কয়েক মাস থাকার পর নিয়ে এলেন বেতাগী আবুল হায়াত মাস্টারের বাড়িতে। সেখানে থেকে বিধু মাস্টারের বাড়িতে সর্বশেষ চন্দনাইশ থাকার জাফরাবাদ গ্রামের আহমদ হোসেন চৌধুরীর বাড়িতে থেকে শিক্ষকতা করি। দেশের অবস্থা খানিকটা স্বাভাবিক হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই এবং শিক্ষা জীবন শেষ করি।
জাতির জনক সপরিবারে জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন। তিনি কখনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করেনি। দেশ স্বাধীনের এক বছরের মধ্যে সংবিধান দিলেও সাংবিধানিক ধারায় বেশী দিন দেশ চালাতে পারেনি। আজ সংবিধানের ৪ (চার) স্তম্ভ আক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু অ-সাম্প্রাদিয়ক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ সুদূর পরাহত বর্তমানে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি’৭৫ এর মত দেশকে অস্তিতিশীল করে তুলেছে। মার্কিন সা¤্রজ্যবাদের নেতৃত্বে পশ্চিমা কিছু দেশ, দেশের কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সরকার বিরোধী ও দেশ বিরোধীরা ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তিকে, দলমত নির্বিশেষ ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ, গড়ার দৃঢ় শপথ নিতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সকল শক্তিকে সুদৃঢ় ঐক্যের প্রয়োজন। জয় বাংলা।