রবিবার,২৫শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

★প্রাচীন পন্ডিত বিহার★ লেখক-বিশ্বজিত বড়ুয়া

প্রাচীন পন্ডিত বিহার
———————–>বিশ্বজিত বড়ুয়া

পন্ডিত বিহার উপমহাদেশের একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। এই পন্ডিত বিহার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক কালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ছিল। পন্ডিত বিহার চট্টগ্রামের আনোয়ারার দেয়াং পাহাড়ে অবস্থিত ছিল। গৌতম বুদ্ধ চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বার্মা বর্তমান মিয়ানমারে গিয়েছিলেন। তার ধারাবাহিকতায় সম্রাট অশোকের সময় থেকে চট্টগ্রামে বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ বিস্তার লাভ করে আসছিল। চৈনিক পরিব্রাজকদের মতে দেয়াং পাহাড়কে দেবগ্রাম বন্দর বলা হত। অনেক পন্ডিত ও গবেষকদের মতে পন্ডিত বিহার স্থাপিত হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে। তিব্বতীয় সূত্র অনুযায়ী বেশ কয়েকটি মহাবিহার একই আদলে স্থাপিত হয়েছিল তার মধ্যে নালন্দা, বিক্রমশীলা, সোমপুর, অদন্তপুরা, জগদ্দল ও পন্ডিত বিহার ইত্যাদি। উক্ত বিহারগুলো তখনকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় পরিচালিত হত। তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি অপরটির সাথে সহযোগিতার ব্যবস্থা ছিল। প্রয়োজনে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পাঠ দান করতেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক পন্ডিত বা অধ্যাপক পন্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ দান করতেন। পন্ডিত বিহার প্রথমে হীনযান বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা পরিচালিত হত। পরে অনেক মহাযানী পন্ডিত এই বিহারে অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন, এবং ধীরে ধীরে মহাযানীদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। ব্রহ্মদেশের রাজা অনর হট ১০৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মহাযান প্রশাসন এর পরিবর্তে হীনযান বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা পরিচালিত করায়। ১২৩০-১২৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজা দামোদর দেব স্বাধীন এবং সার্বভৌম নৃপতি ছিলেন এবং তাঁর রাজত্বকালীন সময়ে পন্ডিত বিহারের অস্তিত্ব উজ্জ্বল ছিল। আরাকানি পুঁথি থেকে জানা যায় একই সময়ে ১২৪৩ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজ অলং ফিউ বাংলা রাজ্য তথা মধ্য চট্টগ্রামের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার সমরাভিযান হরিকেন রাজ্যের মূল ভূখন্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে অতিষ্ট করে তোলে যার ফলে হরিকেল রাজ্যের মূলভূখন্ড মধ্য চট্টগ্রাম – চক্রশালা এবং দেবগ্রাম এ দু’রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়ে।

পন্ডিত বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন চট্টগ্রামের পটিয়া চক্রশালার নিবাসী স্বনাধন্য ব্রাহ্মণ সন্তান তিলপাদ। পরে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে প্রজ্ঞাভদ্র নাম ধারণ করেন। তিনি গৃহী জীবন থাকা কালীন অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পূর্বেও যোগসাধনা করতেন। গবেষকদের মতে পন্ডিত বিহারের একটি শাখা বিহার ছিল বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল এলাকায়, জেনারেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার খনন কাজ সময়ে একটি বুদ্ধ মূর্তি পাওয়া যায় তা নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারে হস্থান্তর করা হয়, যা নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারে বুড়া গোসাই নামে পরিচিত।

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর পন্ডিত বিহারে কিছুকাল অবস্থান করেন এবং অধ্যায়ন ও অধ্যাপনা করেন। তা ছাড়া লুই পা, শরব পা, লাড় পা, অবধূত পা, অমোঘনাথ, ধর্মশ্রী, মৈন, বুদ্ধজ্ঞান পা, অনঙ্গবজ্র প্রমুখ অধ্যাপনা করেন বা পরিদর্শকরূপে ভ্রমণ করেন। তাই অনেকের মতে পন্ডিতরা অবস্থান করার কারণে পন্ডিত বিহার নাম করণ করা হয়।

সিদ্ধাচার্য লুই পা’র নেতৃীত্বে প্রায় চুরাশি জন সিদ্ধাচার্য উপস্থিত হয়ে গান-দোঁহা রচনা করেছিলেন, পরবর্তীকালে গান-দোঁহাগুলো চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষা এবং কাব্যের আদি নিদর্শন হিসেবে সাহিত্য জগতে আকাশচুম্বী স্থান দখল করে আছে। তখনকার সব সিদ্ধাচার্য ওই সময় উপস্থিত ছিলেন তা বলা যাবে না, বা পরবর্তীকালেও যে চর্যা রচিত হয় নাই তা ও বলা যাবে না।

পন্ডিত বিহারের বিলুপ্তি সম্পর্কে জানা যায় ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দে সোনার গাঁওয়ের সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের (১৩৩৮-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ) সেনাপতি কদলখাঁ গাজী চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে আরাকানিদের বিতাড়িত করেন এবং চট্টগ্রামকে সর্বপ্রথম মুসলিম শাসনের আওতায় নিয়ে আসেন। ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে পূর্তগিজরা চট্টগ্রামে আসতে শুরু করে। সময় সুযোগে পন্ডিত বিহারে আক্রমন করে আরাকানীদের পূর্ব দিকে পালাতে বাধ্য করে। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে খ্রীস্টানদের বসতি স্থাপন এবং খ্রীস্টবাণী প্রচারের জন্য ফাদার ফ্রান্সিসকো, ফাদার ডমিনগো ডি, সুজা মিশনারী কাজে আগমন করেন। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে দেয়াং পাহাড়ে গীর্জা নির্মাণ করেন, একই খ্রিষ্টাব্দে দু’জন ডমিকান সন্ন্যাসী আগমন করেন। ১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানদের আক্রমনে বহু খ্রীস্টানদের হত্যা করে সে সময় ফ্রান্সিসকো ফেনার্ন্ডেস এর মৃত্যু হয় ১৫ই নভেম্বর।

১৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দে আরাকান রাজা মেং পলৌং (মুসলিম নাম-সেকান্দার শাহ) মৃত্যুবরণ করলে তার বড় ছেলে মেং রাজ্যাগী (মুসলিম নাম – সলিম শাহ) আরাকানের রাজা নিযুক্ত হন। তার শাসনামলে ১৬০৩ খ্রীষ্টাব্দে দেয়াং এর সামন্ত রাজা হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন, তারই আপন ভাই আনাপোডম। কেন্দ্রীয় রাজার অবাধ্যতার কারণে আরাকানের রাজা আশি হাজার সৈন্য ও সাত হাজার রণহস্তির এক বিশাল বাহিনী নিয়ে সামন্ত রাজা আনাপোডম এর সামন্ত রাজ্য দেয়াং আক্রমন করেন। উভয়পক্ষের ঘোরতর যুদ্ধে রাজা আনাপোডম গুরুতর আহত হয় এবং উভয়পক্ষের বিপুল সংখ্যক বাহিনী হতাহত হয়। আরাকান বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে আনাপোডম স্ত্রী, পুত্র, বোন অরুন্ধতীসহ পর্তুগীজ সেনাপতি গঞ্জালিশের সাথে প্রচুর ধন সম্পদ নিয়ে পর্তুগীজ যুদ্ধজাহাজ নিয়ে সন্দ্বীপে পলায়ন করেন। কিছুদিন পর আনাপোডম সন্দ্বীপে মৃত্যু বরণ করেন। ১৬০৩-১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আরাকান রাজাদের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। তবে ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছিল বাংলার স্বাধীন সুলতান ও আফগান শাসনভুক্ত। ধারণা করা হয় এ সময়েই পন্ডিত বিহারের অবস্থা শোচনীয় হয়। আরাকানের ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, আরাকানের রাজারা কখনো সাময়িক কালের জন্য বা কখনো সম্পূর্ণ মেয়াদে অধিকার করে চট্টগ্রাম অঞ্চল শাসন করে। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজ মিনফালং আফগান সেনানী শাসক জামাল খান পন্নীকে পরাজিতে করে চট্টগ্রাম অঞ্চলকে আরাকান রাজ্যভুক্ত করেন, এবং ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারী পর্যন্ত চট্টগ্রাম একাধারে আরাকানের রাজ্যভুক্ত ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ নিজ পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁকে তার প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করেন এবং তাকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অভিযাবে পাঠান। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ জানুয়ারী মোগল যোদ্ধারা আনোয়ারা উপজেলার চাটিগাঁ দূর্গ দখল করে মগদের বিতাড়িত করে। এ সময় দেয়াং পাহাড়ে অবস্থিত পন্ডিত বিহার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে, পন্ডিত বিহারের মতো বৃহদায়তনের বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষের কোনো স্মৃতি চিহ্ন রাখেননি। সম্ভবত এই বিহারটির নির্মাণসামগ্রী লুণ্ঠনকারীরা নিয়ে গেছে। লোক মুখে শোনা যায়, বর্তমান রাডার ক্যাম্প স্থাপনের সময় ক্যাম্পের সামান্য পূর্বে একটি বৌদ্ধ মন্দিরের চূড়া দেখা গিয়েছিল রাডার ক্যাম্প স্থাপনের জন্য সেই মন্দিরটিকে মাটি চাপা দেওয়া হয়। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে আনোয়ারার দেয়াং পাহাড়স্থ ঝিওরী ও হাজিগাঁও গ্রামের সীমান্ত এলাকায় একটি বাড়ি নির্মাণের জন্য খনন কাজ করতে গিয়ে এক বৃহৎ পাত্রের মধ্যে ৬৬টি পিতলের মূর্তি পাওয়া যায়, এর মধ্যে  বুদ্ধমূর্তি, বোধিসত্ব, অবলোকিতেশ্বর, মঞ্জুশ্রী এবং অন্যান্য মহাযানী দেবদেবীর মূর্তিসহ বিহার বা চৈত্যের ক্ষুদ্র সংস্করণ ইত্যাদি ভান্ডারে রক্ষিত ছিল। এমন মূর্তি ভান্ডার আর কোথায়ও পাওয়া যায় নাই, সেই সব মূর্তি তখনকার সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email