
বিভীষিকাময় হিরোশিমাঃ বিশ্ব ভাবনা দিবস
ডঃ সবুজ বড়ুয়া শুভ
পারমানবিক বোমা। বিংশ শতাব্দীর এক অভিশাপ। শুধুমাত্র একটি বিস্ফোরণ… মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ করে দিতে পারে মানব সভ্যতার সচল সুন্দর গতি। এক নিমিষেই ধবংস করে দিতে পারে সুন্দর ইমারত, সৌধ অট্টালিকা, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, সেতু-টানেল, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, প্রযুক্তির প্রাচুর্য সবি। চোখের পলকে এক নিস্তব্ধ মৃতপুরীতে পরিণত করতে পারে যে কোন নগরীকে। যেমনটি ঘটেছিল হিরোশিমা নগরীতে আজ থেকে ৭৮ বছর পূর্বে ১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দের ৬ আগস্ট। হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত সেই বোমায় ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ লোক মারা যান। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক মারা যান এবং পরবর্তীতে এই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন। জাপানের আসাহি শিমবুন-এর করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২৩৭,০০০ এবং নাগাসাকিতে ১৩৫,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। হিরোশিমা শহরের ১৩ বর্গ কি মি এলাকা সম্পূর্ণ ধবংস হয়ে গিয়েছিল। মানব সভ্যতার মুখে কলঙ্কের কালিমা লেপন করা হয়েছিল সেই দিনে। মানবতা ও মানবধিকারের ছাড়পত্র প্রদানকারী সেই বুর্জোয়া দেশই হরণ করেছিল সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের বাঁচার অধিকার। পারমানবিক বোমার ধ্বংসলীলার সেই মর্মপীড়াদায়ক স্মৃতিগুলো এখনো জানান দিচ্ছে হিরোশিমা ও নাগাসাকির বুকে। ক্ষতিগ্রস্থ সেইসব ভবন, সেখানকার মাটি আর মানুষ। এখনো জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু এবং যা বংশ পরম্পরায় চলতে থাকবে। গুটিকয়েক মানবরূপী দানবের রাজনৈতিক হটকারী সিদ্ধান্তের জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিরাপরাধ সাধারণ মানুষগুলো তার মাশুল দিয়ে যাবে তাতো হতে পারে না। আমরা সবাই স্রষ্টার সৃষ্ট জীব। একি পৃথিবীর আলো বাতাসে বেঁচে আছি আমরা। যুদ্ধ নয় চাই অমৃতময় শান্তির ফল্গুধারা। পারমানবিক মরণাস্ত্রের আগ্রাসন এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপরে পড়েছে। প্রতিযোগতায় নেমেছে পারমানবিক শক্তি সঞ্চয়ের। আর্য্য সভ্যতার দেশ ভারত- পাকিস্তানের মরণমুখী চর্চা সেই অসূরের অন্তরে শান্তিকামী মানুষ আজ শংকিত। বিপন্ন নব প্রজন্ম আর বিপর্যস্ত অনাগত আগামীর চিন্তায় আতংকিত আজ মানবসমাজ। মানব কল্যাণে একদিন বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা সাধিত হয়েছিল। কিন্তু মানব কল্যাণের চাইতে ধবংসাত্মক কর্মকান্ডে বিজ্ঞান বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।
পারমানবিক শক্তির প্রধান উৎস হচ্ছে ইউরেনিয়াম। এই ইউরেনিয়াম বিভাজন বা ফিউশনের ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, যা দিয়ে শত শত বৎসর নির্ভিঘ্নে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব। কিন্তু হায়! সেই অযুত শক্তিকে বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশ গুলো মানবতা বিধবংসী মারণাস্ত্র তৈরীতে তৎপর। ইতিহাসে কুখ্যাত আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রু-ম্যান – এর দম্ভোক্তি আজো অনুরণিত হয় তারই উত্তরসূরী রাষ্ট্রনায়কদের মুখে। যা মানবজাতির জন্য অত্যন্ত ভীতিকর। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত সেই লিটলবয় আর ফ্যাটম্যান কেড়ে নিয়েছিল লক্ষ লক্ষ প্রাণ, আর যারা বেঁচে গিয়েছিল তাদের হাহাকার আর আত্মচিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছিল। লাশের স্তুপ, তেজস্ক্রিয়তায় দগ্ধ ঝলসে যাওয়া পচনশীল শরীর, টগবগে ফুটন্ত নদ-নদী, জলরাশি। সে দিন কী বিভৎস দুঃসহ মৃতপুরীতে পরিণত হয়েছিল তা আজকের তা অচিন্তনীয়, অকল্পনীয় ব্যাপার। সেইদিনে হিরোশিমাবাসী ভেবেছিল সূর্যটাই বুঝি ফাটল। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল সেই দিনের বিমান ক্রুরা যারা ‘এনোলা গে’ থেকে হিরোশিমায় বোমা ফেলেছিল। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। আজকের হিরোশিমার দিকে তাকালে মনে হয় এই বোমা পাল্টে দিয়েছে পুরো জাপানের সামগ্রিক চিত্র। আলো ঝলমল পরিবেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তাবৎ দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়ে গেছে তারা নিশ্চিহ্ন হয়নি, জেগেছে নতুন ঊষার আলোকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমানে পৃথিবীতে যে পরিমান পারমানবিক বোমা মজুত আছে তা দিয়ে পুরো পৃথিবীটাকে বেশ কয়েকবার ধ্বংস করে ফেলা যাবে। বোমা বারুদের উত্তপ্ত পৃথিবীর উপর বাস করছে মানুষ। স্নায়ুযুদ্ধের দিন শেষ হয়ে গেলেও আগ্রাসন, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো খবরদারী, অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদ, অবরোধ, মোরলগিরি সব মিলিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিধর প্রধান প্রধান রাষ্ট্রগুলো তখন মহাবীর হারকিউলিসের বেশে উপস্থিত হয় বিপদ সংকূলপূর্ণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। আগ্রাসনের নেশায় বুঁদ হয়ে তাবৎ দুনিয়াকে শংকিত করে তোলে। মানবাধিকারের মুক্তিসনদ লুটিয়ে পড়ে ধূলিমাঝে… ।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা এবং ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরে আঘাত হেনেছিল দুইটি পারমানবিক বোমা। সেই কলংকময় দিন ৬ আগস্ট ‘হিরোশিমা দিবস’ হিসাবে খ্যাত। যা বর্তমানে World Meditation Day বা ‘বিশ্ব ভাবনা দিবস’ হিসাবে পরিচিত। সারাবিশ্বের সাথে জাপানের জনগণ এই দিনটাকে খুবই ভাবগম্ভীর পরিবেশে শ্রদ্ধাঞ্জলির মাধ্যমে পালন করে থাকে। বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষও এই দিনটাকে বিশেষভাবে পালন করে থাকে। বিশ্ব ভাবনা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো হিরোশিমায় নিহত নিরাপরাধ মানুষের স্মরণে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বোলন, মৈত্রী ভাবনা অনুশীলন, বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা এবং দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৮৮ সালে আমেরিকার লস এঞ্জেলেস -এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘ যুব (World Fellowship of Buddhists- Youth) এর এক সভায় এই বিশেষ দিনটাকে World Meditation Day বা ‘বিশ্ব ভাবনা দিবস’ হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সারাবিশ্বের সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন এই দিনটাকে বিশেষভাবে পালন করে থাকে।
আমরা আর হিরোশিমা-নাগাসাকির পুনরাবৃত্তি চাইনা। সুন্দর শান্তিময়, নবজাতকের বাসযোগ্য বিশ্ব চাই। এই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার। বাংলাদেশও একটি শান্তিপ্রিয় দেশ ও জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে ঘোষণা করবে ~ “যুদ্ধ চাইনা, আমরা ধবংস চাইনা, আমরা পৃথিবীতে শান্তির পতাকা উড়াই…
★★★লেখক পরিচিতি★★★
ডঃ সবুজ বড়ুয়া শুভঃ সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক। বর্তমানে ওয়ার্ল্ড এ্যলায়েন্স অব বুড্ডিস্ট (WAB) -এর সহ-সভাপতি এবং ওয়ার্ল্ড এ্যলায়েন্স অব বুড্ডিস্ট ইয়থ (WABY) -এর চেয়ারম্যান (স্ট্যান্ডিং কমিটি) –এর দায়িত্ব পালন করছেন।