
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ এর জন্মদিনে জীবন সংগ্রামের স্মৃতিচারণ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ পিতা মনোহর আলী মাতা ছবুরা খাতুন, গ্রাম ডেকোটা, ডাকঘর: গৈড়লা, উপজেলা: পটিয়া, জিলা : চট্টগ্রাম। তিনি একজন কৃষক পরিবারের সন্তান, পরিবার কৃষক আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। বাবা মনোহর আলী। তিনি ছিলেন গ্রামের মাতব্বর, তার কথায় গ্রাম ও সমাজ চলতো। অন্য দিকে তিনি একজন কৃষক সমিতির নেতাও ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ পাঁচ ভাই চার বোনের মধ্যে তিনিই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ স্থানীয় গৈরলা কেপি উচ্চ বিদ্যালয় হতে এস.এস.সি, পটিয়া সরকারী কলেজ হতে এইচ. এস. সি ও ডিগ্রী পাশ করেন এবং চাট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাজনীতি বিজ্ঞানে এম. এ পাশ করেন। চাট্টগ্রাম আইন কলেজে অধ্যয়ন করেন। ছাত্র জীবনের শুরু হতে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হন এবং একই সাথে গোপন সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। এই সময়ে ১৯৬৮ সালে পশ্চিম পটিয়া আঞ্চলিক শাখার সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সনে পটিয়া থানা ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্র ইউনিয়নের একজন দায়িত্বশীল নেতা হিসেবে তিনি ছাত্র 1 ইউনিয়ন ছাড়াও তখন কৃষক সমিতির কাজেও জড়িয়ে পড়েন। কৃষকদের নানা সমস্যা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কৃষক নেতাদের আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে পার্টির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ন্যাপের মনোনীত প্রার্থী আনোয়ারা থানার এডভোকেট আবদুল জলিলের নির্বাচন পরিচালনার জন্য আনোয়ায় পাঠান, তিনি প্রায় তিন মাস আনোয়ারায় অবস্থান করেন এবং সুচারুরূপে নির্বাচনী কাজ পরিচালনা করেন। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানী সামরিক শাসক ইয়াহিয়া গড়িমসি শুরু করেন। তখন দেশে প্রতিনিয়ত শহর-গ্রামে-গঞ্জে সভা- করি। সমাবেশ চলতে থাকে। জনগণের মধ্যে মারাত্মক উত্তেজনা দেখা দেয়। ১৯৭১ এর শুরু থেকেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছিল। ৩রা মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান হতে ন্যাপের আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে ন্যাপের এমপিরা ঢাকায় আসলেও পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির এমপিরা ঢাকায় আসেনি। ভূট্টোর এমপিরা সংসদ অধিবেশন বর্জনের হননি। ঘোষণা দেয়ায় সংসদ অধিবেশন না বসায় পূর্ব পাকিস্তান ব্যাপী জনগণের তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। দিন- রাত মিছিলে সমাবেশ চলতে থাকে, তখন শ্লোগান উঠে জাগো জাগো বাঙ্গালী জাগো, বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো পূর্ব বাংলার স্বাধীন করো। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজি শেখ মুজিব। এক দফা এক দাবী পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রহমানের ৭ই মার্চের ভাষনে উচ্চারণ করে “এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”। জয় বাংলা। দেশে টান-টান উত্তেজনা দেশে কি হচ্ছে- কি হবে। তা নিয়ে মানুষের চোখে ঘুম নেই। ৭ই মার্চের ঘোষণার পর মূলতঃ রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যায়, মানুষের দাবী তখন এক দফা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা। এই লড়াই-সংগ্রামের ভেতর পাক সরকার রাজনৈতিক সমাধানের দিকে না গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করে। ব্যাপকভাবে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনতে থাকে। চট্টগ্রাম শোয়াত জাহাজে অস্ত্র আসার সংবাদ পেয়ে চাট্টগ্রামের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। যার যা আছে লাঠিশোটা হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। মেজর জিয়ার উপর দায়িত্ব ছিলো শোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের। এই খবর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জনগণের মধ্যে জানা জার্নি হয়ে যায়। তখন চাট্টগ্রাম শহরে রাস্তায় রাস্তায় সার্বক্ষনিক হাজার হাজার মানুষ। আগ্রাবাদ মেইন রোডে মানুষের তেঁজপুর সেনা নিবাসে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে আমাদের দুই মাসের বেশী সময় গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ট্রেনিং শেষে ত্রিপুরা বাইকোরা নামক স্থানে ক্যাম্পে আনা হয়। কয়েক দিন পর সাবরুম বর্ডার হয়ে ভারতীয় বর্ডার গার্ডের সহযোগিতায় বাংলাদেশে প্রবেশ বর্ডার পাড় হয়ে চাকমা উপজাতির সহযোগিতায় কারণ আমাদের সমস্ত গোলা বারুদ বহন করেন ভারা। তাদের মাধ্যমে ফটিকছড়ি, নারায়নহাট হয়ে বোয়ালখালী চলে আসি। বোয়ালখালী থেকে যেদিন পটিয়া গোপাল পাড়া প্রবেশ করি সেদিন সকাল বেলা আমাদের সাথে পাক বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাক বাহিনীর সহযোগী কয়েকজন মারা গেলেও আমাদের কেউ হতাহত ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশে প্রবেশের পর হতে করলডেঙ্গা রসহরী মহাজনের বাড়ীতে ক্যাম্প এবং কড্রলডেঙ্গা পাহাড়ে ছালতাছড়ি নামক স্থানে ট্রেনিং সেন্টার করে স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে ধলঘাট ষ্টেশন স্থান দখলের যুদ্ধ, ইন্দ্রপুল ধ্বংস করা, গৈড়লার টেকে ঐতিহাসিক সম্মুখ যুদ্ধ এবং যুদ্ধে জয় লাভ, পটিয়া থানায় জাতীয় পতাকা উত্তোলনসহ ছোট খাটো আরো অনেক স্মৃতিচারণ)। অপারেশনে অংশ গ্রহণ করেন। কমরেড শাহ আলমের নেতৃত্বে ভারতের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিশেষ গেরিলা বাহিনীর ১৯ জন গেরিলা বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও স্থানীয়ভাবে করলডেঙ্গা পাহাড়ে প্রশিক্ষনের মাধ্যমে বিরাট গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ মুক্তিযুদ্ধের পর পটিয়া স্বেচ্ছাসেবক বিগ্রেড এর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের পটিয়া থানার সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন শেষে প্রথমে তিনি চট্টগ্রাম শুল্ক বিভাগে চাকুরী করেন এরপর ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে যুগ্ম পরিচালক পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ এর চার কন্যা, বড় মেয়ে সাবরিনা বিনতে আহমদ ( সাকী), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমবিএ, আমেরিকা ভার্জিনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আইটি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে। ২য় মেয়ে সায়মুনা জেনমিন পিংকি এম.বি.বি.এস, বি.সি.এস (ক্যাডার) সরকারী ডাক্তার, ৩য় মেয়ে ইফফাত বিনতে ফজল (ইমু) চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এর কম্পিউটার সায়েন্স হতে এম.এস ডিগ্রী অর্জন করে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন এবং বর্তমানে আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন। ৪র্থ মেয়ে ফারিয়া জেসমিন প্রিমা সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এইচ.এস.সি পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচ. আর. এম এ অনার্স করছেন। তার স্ত্রী জেসমিন আরা বেগম বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রতিষ্ঠানিক কমান্ডের ২০ বছর কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ডের কমান্ডার, সেক্টর কমান্ডার ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১ এর চট্টগ্রাম জেলার সিনিয়র সহ- সভাপতি। বঙ্গবন্ধু সমাজকল্যাণ পরিষদ চাট্টগ্রাম জেলার সিনিয়র সহ-সভাপতি । মুক্তিযুদ্ধকালিন ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার সদস্য সচিব। চট্টগ্রাম নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং চট্টগ্রাম বীর মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতি লি: এর সভাপতি। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু মাষ্টার আবদুস সালামের হাত ধরে। উল্লেখ্য যে, তার গেরিলা দলে ছিলেন, কমরেড শাহ আলম, সামশুজ্জামান হীরা, মো: ইউছুফ, কাজী আনোয়ার, নজরুল ইসলাম, শেখর দস্তিদার, পুলক দাশ, তপন দস্তিদার, মোঃ আলী, মোয়াজ্জেম হোসেন, খামরুজ্জামান, সুজিত বড়ুয়া, প্রিয়তোষ বড়ুয়া, ভূপাল দাশ, মিরা জাফর আহমদ, গোলাম মাওলা । বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন