
হৃদয়ে প্রয়াত শীলালংকার মহাথেরো
লেখক:- রূপানন্দ ভিক্ষু
আজ ২৩ শে মার্চ
বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু মহামান্য অষ্টম সংঘরাজ মহাপন্ডিত শীলালংকার মহাথেরো মহোদয়ের মহা প্রয়াণ দিবস।
চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার অন্তর্গত নানুপুর গ্রামের সদ্ধর্মপ্রাণ উপাসক ও শিক্ষানুরাগী জয়ধন বড়ুয়ার ঔরসে মহিয়সী মাতা শ্যামাবতী বড়ুয়ার কোল আলােকিত করে ১৯০০ সালের ২২শে জুন শুক্রবার ভূমিষ্ট হয়েছিল সুশীল বালক সহদেব আগামীদিনের ভাবি রাজ চক্রবর্তী কিংবা ধর্ম রাজরূপে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে স্থানীয় পাঠশালায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু। আট বছর বয়সে হঠাৎ মাতৃবিয়ােগে জগতের দুঃখ-সত্য অনুধাবন ও অনুশীলন করেন তিলে তিলে। মাত্র তের বছর বয়সে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে জেএমসেন উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়ন ও জ্ঞান চর্চা আরম্ভ করেন।
১৯১৯ সালে অগ্রমহাপন্ডিত প্রজ্ঞালােক মহাথেরের পবিত্র সান্নিধ্য সংসার বিরাগ উৎপন্ন এবং ব্রহ্মচর্য পালনের প্রবল প্রতীতি জন্মায়।
১৯২১ সালে থেরবাদ ও অভিধম্ম শিক্ষার সূতিকাগার এবং দু’দুবার সংগীতির প্রাণকেন্দ্র বার্মার আরাকানে ভিক্ষু পন্ডিত উসুমঙ্গলের নিকট প্রব্রজ্যাধর্মে দীক্ষা, উ তেজরাম মহাথেরের উপাধ্যায়ত্বে উপসম্পদা লাভ এবং শীলালংকার ভিক্ষু নামে পুনজন্ম লাভ করেন। গুরুর সান্নিধ্যে আকিয়াব বনাশ্রমে এবং রেংগুন জাতীয় ধর্মদূত বিহারে ধর্মকর্ম ও বিনয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে অদম্য উৎসাহে সতীর্থ ধর্মতিলক ভিক্ষু এবং শ্রীমৎ জ্যোতিঃপাল ভিক্ষু সহ উপমহাদেশে ধর্ম, বিনয় শিক্ষার অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্থান শ্রীলঙ্কায় গমন করেন। প্রাচীন জনপদ পানাদুরে সদ্ধর্মোদয় পরিবেণে মহাপন্ডিত। উপসেন মহাথেরের উপাধ্যায়ত্বে বার জন পন্ডিত ভিক্ষুর উপস্থিতিতে দ্বিতীয় কর্ম বাচা শ্রবণ এবং ভিক্ষু পরিবাসব্রত পরিক্রমায় অংশগ্রহণ। উল্লেখ্য উক্ত সদ্ধর্মোদয় পরিবেণে তাঁর গুরু অগ্রমহাপন্ডিত প্রজ্ঞালােক মহাথের, রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাথের, অনুসংঘরাজ গুণালংঙ্কার মহাথের, বিনয়চার্য বংশদীপ মহাথের, আর্যশ্রাবক জ্ঞানীশ্বর মহাথের, ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার প্রাপ্ত অধ্যাপক ধর্মাধার মহাথের, অতুলাসেন মহাথের ও অনােমদর্শী শ্রামণ (পররর্তীতে অধ্যাপক বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়)। যারা পরবর্তীতে প্রায় অর্ধশতাব্দিকাল ধর্ম, বিনয়, শীল এবং জ্ঞান চর্চায় মাধ্যমে অবিভক্ত ভারতে সদ্ধর্মের পুনঃজাগরণের নেতৃত্ব দেন ও থেরবাদ ধর্মের বিশুদ্ধ জীবন চর্চায় এবং শাসন ও সংঘ সবার অভূতপূর্ব কল্যাণ সাধন করেন।
১৯২৭ সালে পাঁচ বছর শ্রীলংকায় অধ্যয়নের পর ধর্ম, বিনয় ও ভাষা শিক্ষা, ঐতিহাসিক স্থান ও তীর্থ কেন্দ্র কেন্ডি শহরে বুদ্ধের দন্ত ধাতু দর্শন এবং বিশ্বে প্রাচীনতম বৃক্ষ অনুরাধাপুরে মহাবােধি বৃক্ষ ও সুবর্ণমালী মহাচৈত্য দর্শন। শেষে নানুপুর স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯২৭-১৯৩০ সাল স্বগ্রামে অবিদ্যা দূরীকরণ ও ধর্ম শিক্ষার জন্য “জ্ঞানােদয় লাইব্রেরি” স্থাপন, পরবর্তীতে ১৯৩৬ এবং ১৯৪১-১৯৪৬ সাল পর্যন্ত স্বপল্লীতে আনন্দধাম বিহারে বর্ষাব্রত পালন করেন।
১৯৪৬-১৯৪৭ সালে ১ম সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরের আহবায়ক ভাষাবিদ রাধাচরণ মহাথেরের স্মৃতি ধন্য ও পুণ্যস্নাত, গুরু প্রজ্ঞালােক মহাথেরের এবং মহাবর্গ প্রণেতা গুরুভাই, প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরের জন্মস্থান বৈদ্যপাড়া শাক্যমুনি বিহারে অধ্যক্ষের পদ অধিষ্ঠিত হন। তারপর ১৯৬৭-২০০০ সাল পর্যন্ত মির্জাপুর শান্তিধাম বিহারে। অধ্যক্ষ পদ গ্রহন।
১৯৬৪ সালে ভদন্ত জ্ঞানশ্রী থেরের সহায়তায় ত্রিপিটক প্রচার বাের্ড” প্রতিষ্ঠা করেন এবং বহু ধর্মগ্রন্থ বাংলায় প্রকাশের সু-ব্যবস্থা করেন। তাঁহার ধর্মগ্রন্থ মধ্যে রাহুলচরিত (১৯৩৭), অজাতশত্রু (১৯৩২), বুদ্ধযুগে বৌদ্ধ নারী (১৯৩৩), পারাজিকা (১৯৩৭), বিমানবথু (১৯৩৮), ধর্মপদঠকথা (১৯৪৩), জীবক (১৯৬৪), বৌদ্ধ নীতি মঞ্জরী(১৯৬৫), আনন্দ (১৯৬৭), জাতকাবলী (১৯৬৮), বিশাখা (১৯৭১), প্রভৃতি গ্রন্থ বাংলা সাহিত্য, মানবতা ও ধর্ম প্রচারে তাঁর অভাবনীয় সংযােজন। তিনি ১৯৭৫ সালে ২৬শে ফ্রব্রুয়ারি সাতবাড়িয়া শান্তি বিহারে সদ্ধর্মকৃর্তী সপ্তম সংঘরাজ অভয়তিষ্য মহাথেরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পূর্ব রাত্রিতে বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা কর্তৃক সংঘরাজ এবং মহাসভার সভাপতি পদে বরিত হন। ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারে সংরক্ষিত পবিত্র বুদ্ধের কেশধাতু প্রদান উপলক্ষে দ্বিতীয়বার থাইল্যান্ডে গমন করেন। ১৯৭৯ সালে মঙ্গোলিয়া ও সােভিয়েত ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত পঞ্চম এশিয়া বৌদ্ধ শান্তি মহাসম্মেলনে যােগদান করেন। মঙ্গোলিয়ার সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু মহামান্য খাম্বােলামা গাম্বােজেব, নােবেল বিজয়ী মহামান্য দালাইলামা এবং জাপানী বৌদ্ধ নেতা নিচিদাৎসু ফুজি গুরুজী প্রমুখ বৌদ্ধ ব্যক্তিত্বের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। ১৯৮১ সালে মহামান্য সংঘরাজ নিচিরেন মহাবােধিসত্ত্বের ৭০০ তম জন্মবার্ষিকীতে জাপানে যােগদান ও এশীয়দের পক্ষে একক বক্তৃতা প্রদান করেন।
১৯৮২ সালে বুদ্ধগয়া আন্তর্জাতিক ভাবনা কেন্দ্রে ও সত্যনারায়ণ গােয়েংকাজীর প্রতিষ্ঠাত “বিশ্ব বিদ্যাপীঠ ” ভাবনা কেন্দ্রে ধ্যানানুশীলন ও বিভিন্ন স্থানে সংবর্ধনা লাভ করেন। ১৯৮২ সালে সাধক রাজবন বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত সাধনানন্দ মহাথেরের আহবানে উক্ত বিহারে বনভান্তের সাথে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান ধরেন।
১৯৬৬ সালে অসামান্য অনুবাদ, ভাষার দখল, ব্যাকরণ ব্যবহারে নৈপুণ্য এবং শব্দ অলংকার প্রয়ােগে প্রাঞ্জল ও মনােজ্ঞ পরিস্ফুটনে দক্ষতার ছাপ প্রমাণিত হওয়ায় বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা কর্তৃক “সাহিত্যরত্ন ” উপাধি প্রদান করেন। ১৯৮১ সালে মির্জাপুর শান্তিধাম বিহারে হীরক জয়ন্তী উদযাপনের মাধ্যমে দায়ক সংঘ, ভিক্ষু ভিক্ষু সংঘ এবং সর্বস্তরের শান্তিপ্রিয় মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
১৯৯৬ সালে প্রজ্ঞালােক-জিনবংশ কল্যাণ ট্রাস্টের ” বার্ষিক অধিবেশনে ” পন্ডিত সুগতবংশ মহাথেরের সভাপতিত্বে মহামান্য সংঘরাজকে “প্রজ্ঞালােক-জিনবংশ” স্বর্ণপদক প্রদান। ১৯৯৯ সালে মায়ানমার সরকার কর্তৃক বিরল সম্মান “অগ্নমহাসদ্ধর্মজ্যোতিকাধ্বজক” উপাধি লাভ করেন।
শতাব্দীর সূর্য সন্তান, শীল, বিনয় ও পান্ডিত্যে শ্রেষ্ঠ, বাগ্মিপ্রবর, সংঘশক্তি পত্রিকার সম্পাদক, সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার প্রাক্তন সভাপতি, সাহিত্যরত্ন, প্রচারবিমুখ সাধক, শান্তির দূর, বিশ্বে ধর্ম, কর্ম, কৃষ্টি, সাহিত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে এক অবিস্মরণীয় নাম, সংঘ শাসন সমাজের অহংকার মহামান্য অষ্টম সংঘরাজ শীলালংকার মহাথের ২০০০ সালে ২৩ মার্চ মহাপ্রয়াণ করেন। ২০০১ সালে ১৮-১৯ জানুয়ারি মহাসমারােহে মির্জাপুর শান্তিধাম বিহারে জাতীয় ও আন্তজার্তিক ভাবে সুসম্পন্ন হয়।
সংগ্রহ :- অষ্টম সংঘরাজ ভান্তের স্মরণিকা।সূত্র সংগৃহিত,ত্রিরত্ন সংকলন।
নিউজটি পড়েছেন : ১৫৬