
ডিজিটাল থেকে স্মার্টঃ আমাদের করণীয়
ড. সুব্রত বরণ বড়ুয়া
” ডিজিটাল বাংলাদেশ ” কথাটির সাথে আমরা প্রথম পরিচিত হই ২০০৮ সালে। এর লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীত অর্থাৎ ২০২১ সালে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিনত হবে। একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, রূপান্তরিত উৎপাদন ব্যবস্থা, জ্ঞান ভিত্তিক অর্থনীতি এবং প্রযুক্তি নির্ভর দেশ গঠন করা।
“ডিজিটাল” শব্দের অর্থ হলো সংখ্যাগত। ডিজিট হলো বিশেষ্য আর ডিজিটাল হলো ক্রিয়া। অর্থাৎ ডিজিট অর্থ সংখ্যা আর ডিজিটাল হলো গণনা করা। কম্পিউটার হলো গণনাকারী যন্ত্র, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এর ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক। শাব্দিক ক্ষেত্রে ডিজিটাল এর অর্থ খুঁজলে তেমন একটা গুরুত্ব বহন করেনা। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে ডিজিটাল শব্দটি বর্তমান প্রযুক্তির যুগে মানুষের সাথে মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ স্থাপন ছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা প্রদান/দেয়া হলো ডিজিটাল। আরো সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় সহজ, সঠিক, দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করতে পারা হলো ডিজিটাল। ডিজিটাল এর উপাদান হলো ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, ওয়েবসাইট ইত্যাদি সবগুলোই হলো ডিজিটাল এর উপাদান। এগুলোকে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজন ইন্টারনেট ও কম্পিউটার আর ইন্টারনেট ও কম্পিউটার হলো ডিজিটাল এর মূল বিষয়বস্তু।

” ডিজিটাল বাংলাদেশ ” এর মূল স্থম্ভ হলো ০৪ টি। ১) মানবসম্পদ উন্নয়ন ২) ইন্টারনেট সংযোগ ৩) ই প্রশাসন ৪) তথ্য প্রযুক্তি ভিত্তিক শিল্পখাত গড়ে তোলা। এই চারটি মূল স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ও অর্জন চুড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। যেমন-
সরকারি সেবা ও তথ্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশে তৈরি করা হয়েছে বেশ কয়েকটি সরকারি মোবাইল হেল্প ডেক্স। এই মোবাইল হেল্প ডেস্কগুলোর নির্দিষ্ট নম্বরে কল করার মাধ্যমে মানুষ সহজেই সরকারি তথ্য ও সেবা পাচ্ছে। এই সবগুলো নম্বর টোল ফ্রি সেবার আওতায়। বর্তমানে বাংলাদেশে এমন বেশ কয়েকটি সরকারি হটলাইন নম্বর রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিষয় হট লাইন
সরকারি তথ্য ও সেবা ৩৩৩
জরুরি সেবা (পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, এম্বুলেন্স) ৯৯৯
বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। ফলে সরকারি কোন বিশেষ ঘোষণা মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে সরাসরি ঐ সকল ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের নিকট সহজে পৌঁছানো যাচ্ছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক ইন্টারনেট সংযোগের ফলে বর্তমানে দেশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনলাইন প্ল্যাটফরম। যেমন ১০ মিনিট স্কুলসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষামূলক প্ল্যাটফরম। সরকারিভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য e-books প্ল্যাটফরম তৈরি হয়েছে। এতে ৩০০টি পাঠ্যপুস্তক ও ১০০টি সহায়ক পুস্তক রয়েছে।
সকল পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, পরীক্ষার নিবন্ধন, চাকরির আবেদন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে।
গ্রাহকেরা বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস বিল অনলাইনে অথবা মোবাইল ফোনে পরিশোধ করতে পারেন।
প্রায় সকল বাস, ট্রেন, প্লেনের টিকিট অনলাইনে অথবা মোবাইলে সংগ্রহ করা যায়।
মোবাইল ব্যাংকিং ( বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, ইজি ক্যাশ), ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার ( ইএফটি) এর মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে অর্থ প্রেরণ সহজ ও দ্রুততর হয়েছে।
২০১৮ সালের ১২ মে মহাকাশে প্রেরণ করা হয় বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ” বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১”
সরকারের বড় বড় উন্নয়নমূলক কাজে ” ই টেন্ডারের” মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন করা হয় বিধায় দূর্নীতি কমানো সম্ভব হয়েছে।
সর্বোপরি ডিজিটাল বাংলাদেশ এর এক সফল রূপ দেখতে পাই করোনা মহামারী’র সময়ে। এ সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অফিস-আদালত, চিকিৎসা সেবা, স্কুল – কলেজ – বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, ব্যবসা- বাণিজ্য চালু রাখা সম্ভব হয়েছে।
সরকারের ৪টি মাইলস্টোন এর মধ্যে প্রথম ২০২১ সালের রূপকল্প ডিজিটাল বাংলাদেশ, দ্বিতীয় ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা, তৃতীয় ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা চতুর্থ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ সালের জন্য। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে দক্ষ নাগরিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ রূপান্তরের মহাপরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করার জন্য তিনি চারটি মূল ভিত্তির কথা বলেন।
১) স্মার্ট সিটিজেন – অর্থাৎ আমাদের প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করবে।
২) স্মার্ট ইকোনমি – অর্থাৎ আর্থিক সমস্ত কার্যক্রমে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
৩) স্মার্ট গভর্নমেন্ট – সরকারের প্রত্যেকটি কার্যক্রম প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে।
৪) স্মার্ট সোসাইটি – সমাজের সকল স্তরের মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজের উন্নয়ন সাধন করবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে এই চারটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে অগ্রসর হতে হবে। স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট সরকারের মাধ্যমে সব সেবা ও মাধ্যম ডিজিটালে রূপান্তরিত হবে। আর স্মার্ট সমাজ ও স্মার্ট অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, জ্ঞান ভিত্তিক, বুদ্ধিদীপ্ত ও উদ্ভাবনী। এক কথায় সব কাজ হবে স্মার্ট। যেমন স্মার্ট শহর, স্মার্ট গ্রাম বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট পরিবহন, স্মার্ট ইউটিলিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট সংযোগ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এক শিক্ষার্থী, এক ল্যাপটপ, এক স্বপ্নের উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এর আওতায় সব ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত ক্লাউডের আওতায় নিয়ে আসা হবে। ইতোমধ্যে “ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্ক ফোর্সের” নাম পরিবর্তন করে “স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্ক ফোর্স” করা হয়েছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করতে আমাদের হাতে সময় আছে ১৮ বছর। এই সময়ে তরুণ প্রজন্মকে দক্ষ নাগরিক হিসেবে আমাদের গড়ে তুলতে হবে। যারা এখন শিক্ষার্থী তাদের বৈশ্বিক প্রয়োজনীয়তার নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ” আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অনেক মেধাবী, তাদের দেশের উন্নয়নে গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরও বলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে সোনার ছেলে-মেয়ে হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করতে হবে। যাতে তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ থেকে দূরে থাকে।”
“স্মার্ট বাংলাদেশ” গঠন করার জন্য সকল ভিত্তির জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত ও দক্ষ জনবল। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী জাতীয়ভাবে সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ। সাক্ষর পুরুষের হার ৭৬.৫৬ শতাংশ ও সাক্ষর নারীর হার ৭২.৮২ শতাংশ। তবে শুধুমাত্র সাক্ষরতা নিরিখে জনগণকে শিক্ষিত না ভেবে প্রয়োজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা সৃষ্টির লক্ষে বহুমুখী কারিগরী শিক্ষা ও ব্যাপক প্রশিক্ষণ। ২০৪১ সালে বাংলাদেশের উন্নত বিশ্বে শামিল হওয়ার আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সকল স্তরের জনগণের উন্নয়ন কাজে অংশগ্রহণ। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন উপযুক্ত প্রায়োগিক ও কারিগরি শিক্ষা এবং যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ। তবে একথা নির্দ্বিধায় মেনে নিতে হবে যে, আমাদের দেশে শিক্ষার হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার মান ও তার উপযোগিতা হ্রাস পেয়েছে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার রূপকল্প হলো এমন একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করা, “যে দেশে পুরুষ ও নারী সমান সুযোগ ও অধিকার পাবে এবং নারীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমান অবদানকারী হিসেবে স্বীকৃত হবে। ” শিক্ষার চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উচ্চ শিক্ষার মূল চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে মধ্যে রয়েছে শিক্ষার মান, কম তালিকাভুক্তি এবং শ্রমবাজারে প্রাসঙ্গিকতা। ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, তাদের ৩৮.৬০ শতাংশ কর্মহীন। ৩৪ শতাংশ উচ্চ শিক্ষিত স্নাতক সম্পন্ন করার দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে চাকরি পায়। শ্রমবাজারের প্রাসঙ্গিকতার জন্য চ্যালেঞ্জ হলো শিল্প-শিক্ষার মধ্যে সহযোগিতার অনুপস্থিতি। এর ফলে যা শেখানো হচ্ছে এবং কর্মস্থলে যা ঘটবে, তার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব তৈরি হয়। শুধুমাত্র পরিকল্পিত উপায়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব।
লেখক পরিচিতি
উপাধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম। সাধারণ সম্পাদক – বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ যুব।