বৃহস্পতিবার,২৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জয়পুরহাটে পাট বিক্রি করে লাভ বালাই নেই,পাট চাষে চাষীদের অনীহা

জয়পুরহাটে পাট বিক্রি করে লাভ বালাই নেই,পাট চাষে চাষীদের অনীহা

জয়নাল আবেদীন জয়

জয়পুরহাট প্রতিনিধিঃ-
‘আগে পাটের দাম কম ছিল। দ্রব্যমূল্যও কম ছিল। ওটা বিক্রি করে আমরা চলতে পারছি। এখন দ্রব্যমূল্য বেশি, পাটের দাম কম। এটা বিক্রি করে নিজের তো কিছু থাকে না। সারের দাম বেশি। গত বছর ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা দরে প্রতি মণ পাট বিক্রি করেছি। কিন্তু এবার পাচ্ছি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ১০০ টাকা। তাছাড়া এবার উৎপাদনও কম। এই টাকায় পাট বিক্রি করলে আমাদের লোকসান হবে।’কথাগুলো বলছিলেন জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার উচনা এলাকার কৃষক মাহফুজার, মিরশহীদ,আলম। ওনারা দু এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করে এবার লাভ নয়, খরচ তোলার হিসাব করছেন।

কৃষক আলম বলেন, আমার চাওয়া সব কিছু নায্যমূল্যে পাব। সারের দাম কম পাব। পাটের দাম ঠিক মতো পাব। তাহলে আমরা কৃষকেরা চলতে পারব।
এবার জয়পুরহাট জেলায় ৩ হাজার ১১৮ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। চলতি বছরের খরিপ-১ মৌসুমে জেলায় ৩ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫২ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ কম হয়েছে। গত মৌসুমে ৩ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। গত মৌসুমের তুলনায় এবার ৩৭৭ হেক্টর জমিতে এই ফসলের আবাদ কমেছে।

গত মৌসুমে ৮ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ২৬২ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন কম হয়েছে। এবার ৮ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
এ বছর সদর উপজেলার ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর, পাঁচবিবি উপজেলায় ১ হাজার ৪৬০ হেক্টর, কালাই উপজেলায় ২৪৫ হেক্টর, ক্ষেতলাল উপজেলায় ৫০ হেক্টর ও আক্কেলপুর উপজেলায় ১৩ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। গত মৌসুমে ৮ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন। এই মৌসুমে ৮ হাজার ৫৬০ মেট্রিক টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৯৫ শতাংশ পাট কর্তন করা হয়েছে।
তবে এবার তেমন বৃষ্টির পানি না পাওয়ায় পাটের ফলন কম হয়েছে। তাছাড়া গত বছরের তুলনায় এবার পাটের দামও কম। কম দামে পাট বিক্রি করে লাভ নয়, খরচ উঠানোর চিন্তায় রয়েছেন পাট চাষিরা। এতে মলিন হয়ে গেছে কৃষকের সেই সোনালি হাসি।
পাঁচবিবির ছোট মানিক এলাকার কৃষক রিপন হোসেন ৩৩ কাঠা অর্থাৎ ৫৫ শতক জমিতে পাট চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এই মৌসুমে পাট চাষে খরচ বেশি হয়েছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবার এক বিঘা জমিতে হাল-চাষ, শ্রমিকের মজুরি, সার-সেচসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর এ বছর বৈরী আবহাওয়ার কারণে পাটের ফলন কম হয়েছে। তাছাড়া পাটের যে বাজার দর যাচ্ছে তাতে দুই মণ পাট ১ হাজার ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। এই দরে বিক্রি করে পাট চাষ করা যাবে না। কেননা প্রতি বিঘায় এবার ৮ থেকে ৯ মণ পাট হবে। এর দাম আসবে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। এতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে। সেই হিসেবে পাট চাষ লোকসানের ফসল হয়ে যাবে।
সব খরচ বাদে পাটে কিছুই থাকবে না। এর চেয়ে কচুর লতি চাষ করে বেশি লাভবান হচ্ছেন কৃষক আব্দুল আলিম। এক বিঘা জমিতে ৮৮ হাজার টাকায় কচুর লতি বিক্রি করেছেন তিনি। এজন্য পাট চাষ কমিয়ে দিতে চান এই কৃষক।
তিন বিঘা জমিতে এবার পাট চাষ করেছেন বিপুল বর্মণ। তিনি চাকরির সুবাদে বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকেন। আর জমি চাষাবাদের হিসেব ও দেখাশোনা করে থাকেন তার স্ত্রী রঞ্জিতা বর্মণ।

তিনি বলেন, পাট লাগানোর পর মেলানো (নিড়ানি দেওয়া), কাটা, উঠানো, আবার ধোয়ার জন্য অনেকগুলো শ্রমিক লাগছে। কিন্তু পাটের দাম কম। এতো কষ্টের পরও যদি পাটের দাম না পাই, তাহলে পাট লাগিয়ে লাভ কী? দুই হাজার টাকা মণ পাট বিক্রি করে লাভ নেই। খরচই উঠবে না। তাছাড়া কৃষি বিভাগ থেকেও কোনো সহযোগিতা পাই না।
প্রতি বিঘায় বীজ, সার, সেচ, কর্তন, জাগ দেওয়া, ধুয়ে নেওয়াসহ নানা বাবদ ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আর বিঘায় এবার ৮ থেকে ৯ মণ পাট উৎপাদন হয়েছে। প্রকারভেদে পাটের দাম ১ হাজার ৮০০ টাকা থেকে ২ হাজার ২০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি করা পাটের দাম হচ্ছে ১৫ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা। এই দামে পাট বিক্রি করার চেয়ে অন্য ফসল চাষে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা।

পাট চাষি আব্দুল আলিম বলেন, দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছি। এবার দেখা গেছে বিঘা প্রতি ৯ মণ পাট হয়েছে। এই পাটে আমাদের লাভ হবে কি? বাজারে দাম নেই, দুই হাজার টাকা মণ পাট বিক্রি করে কোনো লাভ আছে? পাট জাগ দেব অন্যের খালে, তারও ভাড়া দিতে হবে। আবার পাট ধোয়া ৬০০ টাকা কুড়ি। সব খরচ বাদে আমাদের কিছুই থাকবে না। এর চেয়ে কচুর লতি চাষ করে বেশি লাভবান হচ্ছি। এক বিঘা জমি থেকে ৮৮ হাজার টাকায় কচুর লতি বিক্রি করেছি। পাটে লাভ বেশি নাকি কচুর লতিতে? তাই পাটের চাষ কমিয়ে দেব।

বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে পাট রোপণ ও পঁচানোতে সমস্যা হয়েছে। আবার শ্রমিকের মজুরিও বেশি। সেই অনুযায়ী কৃষকেরা পাটে মূল্য পাচ্ছে না।
মো. আব্দুল হালিম, মুখ্য পরিদর্শক, পাট অধিদপ্তর জয়পুরহাট আরেক পাট চাষি আব্দুল করিম বলেন, কম পক্ষে ৩ হাজার টাকা পাটের মণ থাকা লাগবে। তাহলে কৃষকের পোষাবে (লাভবান হবে)। ২০ আঁটি পাট কাটতে লাগছে ৬০০ টাকা। ওই ২০ আঁটি পাটে এক মণ পাট হবে। তাহলে ২ হাজার টাকায় পাট বিক্রি করে কাটার খরচ ৬০০ টাকা বাদ দিলে ১ হাজার ২০০ টাকা থাকছে। আবার ওই পাট ধুতে ৫০০ টাকা। জমিতে হালচাষ, সার, সেচের খরচ আছে। আমার শ্রমের খরচ না হয় বাদই দিলাম। তাহলে এই এক বিঘা পাটে কত খরচ হলো, আর দাম কত পেলাম। তার হিসাব কেউ করে? এভাবে তো পাট চাষ করা যায়

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email