শুক্রবার,২৩শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

খালী কলসি কী,অমঙ্গলের প্রতিক? —-শিক্ষক মিলন কান্তি বড়ুয়া

খালী কলসি কী,অমঙ্গলের প্রতিক?

—-শিক্ষক মিলন কান্তি বড়ুয়া

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমন অনেক গুলো উক্তি আছে, যা যুগের পর যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে যেমন প্রচলিত তেমন বাংলা সাহিত্য ও ব্যাকরণে প্রকৃষ্ট বচন বাদ স্বরূপ সমাদৃত হয়ে আছে। প্র উপসর্গ বাদ কিংবা বচন শব্দের পূর্বে গঠিত শব্দ প্রবাদ বা প্রবচন।
প্র প্রকৃষ্ট অর্থে বাদ বা বচন বা কথার যথার্থ অর্থে ব্যবহার হয়ে প্রবাদ প্রবচন শব্দটির উৎপত্তি বা গঠিত হয়েছে। অনেকদিন ধরে জনসাধারণের মুখে মুখে প্রচলিত অসংখ্য অর্থবোধক জনপ্রিয় উক্তি রয়েছে যার মধ্যে সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় জীবনের গভীরতর সত্য প্রকাশ করেছেন। জীবন, জগত, সমাজ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জ্ঞানী গুণী মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতায় সৃজিত লোকসাহিত্যই প্রবাদ প্রবচন।
লোক পরস্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত উক্তি গুলো, কে, কবে, কখন, কিভাবে, এধরণের ছন্দোবদ্ধ অর্থবোধক বাক্য গুলো রচিয়তা বলা না গেলেও উৎস সম্পর্কে কিছুটা ধারনা করা যায়। এসব উক্তি সমূহকে গবেষণা করলে উৎস ধারণা করা যেতে পারে। তেমনি চট্টগ্রামের (আঞ্চলিক ভাষায়) অসংখ্য কথার মধ্যে লুকে আছে, প্রবাদ প্রবচন। গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, এসব উক্তির মূখ্য উদ্দেশ্য সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় রচিত সান্ত্বনা, সাহস, ধৈর্য্য, ভয়, ভ্রৃতি, পাপ পূণ্য, সংস্কার আর কুসংস্কার।
প্রবাদ প্রবচনের গুলো মধ্যে মানুষকে কাবু করার মত শক্তিশালী অস্ত্র হলো, ভালো নয়, অমঙ্গল, পাপ, সন্তানের ক্ষতি ইত্যাদি ইত্যাদি। কি এবং কেনর উত্তর বিহীন প্রশ্নই করা মাত্র। সত্য অসত্য, সংস্কার কুসংস্কার মানুষের হৃদয় মন্দিরে রন্ধে রন্ধে শিরায় উপশিরায় প্রবেশ করেছে মজবুত অবস্থানে। এসব অমঙ্গল বা পাপ নিরাময়ে ভন্ড, প্রতারক, ফকির, দরবেশ, বেদে, বৈদ্য, ওজা, হাট ঘাট বসিয়ে তাবিজ, কবজি, পানিপড়া দিয়ে, বান টোনা, জ্বিন ভুত তারানোর ব্যবসা করে হাজার হাজার মানুষ কে নিঃশ্ব করে দিচ্ছে ।
অন্ধ বিশ্বাসে কুসংস্কারের বেড়া জালে আবদ্ধ অসংখ্য জনগণ। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর পায়ের নক হতে মাথার চুলে পর্যন্ত চলন বলনের বিধিবিধান পুঙ্খানু পুঙ্খ ভাবে রচিত মহাকাব্য। সমাজে নারীর চারিত্রিক বিচার করার অধিকার পূর্নাঙ্গ পুরুষের হাতে ন্যস্ত। নারী কিভাবে কথা বলবে, উচ্চস্বরে কথা বলা যাবে না, কথায় থাকবে কোমলতা, মার্জিত রুচির পোশাক পরিচ্ছদে থাকবে, কতটুকু হাসবে, হাসির ধরণ, হাঁটতে পা’য়ের শব্দ, পা’য়ের তলা সমান আছে কি?না? যা কিছুর পরিমাপ থাকবে নারীকে তার মাপজোখ নিয়ে পা ফেলতে হবে। নারীর কোন কিছুই নারীর জন্য নয়। পুরুষ যে পোশাক নারীর জন্য আদর্শ মনে করে, সেই পোশাক পড়তে হবে। নারীকে গৃহবন্দী করে অহংকার করে বলে, নারীর কাজ সংসার সামলানো আর সন্তান লালন পালন করা, দেখা শুনা করা। প্রচলিত কয়েকটি প্রবাদ প্রবচন নিয়ে সংস্কার কুসংস্কার চিত্র দেখুন। যেমন খালি কলসি অমঙ্গল, বালিশে বসলে পাছায় ফোড়া উঠে, (বালিশে বসলে ছিড়ে জাবে), সবুরে মেওয়া ফলে (ধৈর্য্য ধরনের জন্য), কালা গলার মালা, জাতের মেয়ে কালা ভালা, নদীর জল ঘোলা ভালা, (কালো রঙের মেয়েদের বিবাহ করতে উৎসাহ প্রদান, সান্তনা স্বরূপ), ভাত খেয়ে পাথে পানি ডাল, (ভাত খাওয়ার পর প্লেটে পানি দিলে প্লেট পরিস্কার কষ্ট কমে হয়), মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত,(প্রত্যেকের যোগ্যতা সীমাবদ্ধ), ছেলে নষ্ট হাটে, মেয়ে নষ্ট ঘাটে,(ছেলে মেয়েদের শাসন করার জন্য) ইত্যাদি ইত্যাদি।
আবহমান বাংলায় সমাজ শাসন পদ্ধতি প্রাচীন কাল থেকে রক্ষণশীল এবং পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষশাসিত। রক্ষণশীলতা হলো যুগোপযোগী কোন বিষয়কে বা পরিবর্তনকে সহজে মেনে না নেওয়া। পুরাতন ধ্যান ধারনাকে লালন পালনে বিশ্বাসী, এ ঐতিহ্যকে বংশপরম্পরায় বিস্তারে বংশানুক্রমিক ধারা অব্যহত রাখতে দৃঢ় প্রয়াসী। পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় পবিবারের সকল সদস্যের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সহ যাবতীয় মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে, তাদের ভরণপোষণের ও নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতা পিতা বা পুরুষের হাতে ন্যস্ত থাকে।
পুরুষের আধিপত্য বিস্তারে পুরুষগণ তাঁদের ক্ষমতা, নেতৃত্ব, কর্তৃ্ত্ব বজায় রাখতে পুরুষের সুযোগ সু্বিধা বিবেচনায় সুদৃষ্টি রেখে, নারী, শিশু, বয়োকনিষ্টদের নিয়ন্ত্রন রাখতে নানান বিধিবিধান তৈরি করেন। এ বিধানে সামাজিক সুযোগ সুবিধা ও সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য স্থাপন করে পরিবারের কর্তা, পিতা, পিতৃতুল্যগণ। যাঁরা নারী ও শিশুর ভরণ পোষণসহ কতৃত্ব লাভ করে। পিতৃ বংশপরম্পরায় পিতার পরিচয়, যার অর্থ হচ্ছে, সম্প্রদায়, সমাজ, সম্পত্তি ও পদবি পুরুষের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত বা রূপান্তরিত হয়ে আসছে, অনন্ত কাল ধরে।
ঐতিহাসিক ঐতিহ্যে বাঙালির সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন সংস্কৃতির বিস্তৃত পরিসরে সামাজিক, আইনগত, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পিতৃত্বের অস্তিত্ব বিরাজমান। এখানে স্পষ্ট প্রত্যয়মান হয় যে, নারীরা গৃহস্থালি কাজে ও অভ্যন্তরিন কাজে তাঁদের প্রাধান্য কিংবা সীমাবদ্ধ।

“খালি কলসি অমঙ্গল, পূর্ণ কলসি মঙ্গল” কী রকম অমঙ্গল ,কী রকম মঙ্গল? প্রশ্নের উত্তর নেই। সে রকম অনেক প্রশ্নে উত্তর ভালো নয়, কী রকম ভালো নয় জানতে চাইলে উত্তর নেই।
ছন্দোবদ্ধ এ উক্তিটি নারীদের গতিশীল করতে ভয় দেখাতে রচিত কিংবা প্রচলিত প্রবাদ। কাকতালীয় ভাবে কারো যাত্রা পথ খালি কলসি দেখে যাওয়াতে কিছু মঙ্গলজনক নয় এমন কিছু ঘটে গেলেও ঘটতে পারে। তা যে চিরন্তন সত্য বলা যায় না। এটা অবশ্যই কুসংস্কার।

কেনই বা এ উক্তিটি প্রচলিত? ধারণা করা যায়, নলকূপ আবিষ্কারের পূর্বে বাংলার জনসাধারণ পুকুরের পানি পান করতো। যে পুকুরের পানি পান করতো, পানীয় জলের জন্য পুকুরের পানি পরিস্কার রাখতে লোকালয় হতে কিছু দূরে, ফসলি জমির মাঝে পুকুর খনন করা হতো। স্বাভাবিক বা নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে যাতে কেউ করতে না পারে। এমনিতে মহিলারা গৃহস্থালি কাজে ব্যস্ত থাকায়, একে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করার সুযোগ তেমন নেই, তাই দু’জন মহিলা একত্রিত হলে গল্প জুড়িয়ে দেয়। পানীয় জলের পুকুর লোকালয় থেকে দূরে হওয়ায় দল বেঁধে গায়ের বধুরা পানি আনতো। খালি কলসি নিয়ে পথে পথে গল্প না করার জন্য অমঙ্গল শব্দটি যুক্ত করে, ভয় প্রদর্শন স্বরূপ অমঙ্গল নামক অস্ত্রটি ব্যবহার করেছে। কেউ পানি পূর্ণ ভারি কলসি নিয়ে অন্তত দাড়িয়ে গল্প করবে না,তাই। আবার ঘাটে বসে গল্প জুড়ে না দেওয়ার জন্য আরও একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। মেয়ে নষ্ট ঘাটে, ছেলে নষ্ট হাটে। যাতে মহিলারা পুকুর ঘাটে গল্প না করেন। আরও প্রসঙ্গ ক্রমে কৃষ্ণলীলা, দেওয়ানা মদিনা, মলকা বানু, দেবদাস পার্বতী প্রেম কাহিনী’র বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত গুলোর উদাহরণ টেনে উক্তিটির যথার্থ দেখিয়ে প্রমান করে থাকেন। যা রক্ষণশীলতার বৈশিষ্ট্য কে ফুটিয়ে তুলেন।
খালি কলসি ও পূর্ণ কলসির সাথে মঙ্গল অমঙ্গলের কোন সম্পর্ক নেই বিধায় এটি কুসংস্কার। আসুন, যুগোপযোগী সময়ের সাথে কুসংস্কার ও পুরাতন ধ্যান ধারনা পরিহার করে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত সংস্কারকে বরণ করায় যুক্তিযুক্ত।

অতএব, খালি কলসি অমঙ্গলের প্রতীক নয়।

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email