
কৃষ্টি প্রচার ও আমাদের সংবেদনশীলতা
জনি বড়ুয়া
বলা বাঞ্ছনীয় যে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ বাঙালি বৌদ্ধদের প্রথম সংগঠন নয়। তবু সত্তুর পেরিয়ে আশিতে হাঁটছে। প্রচার সংঘের ব্যক্তি বিশেষের নাম উচ্চারণ না করে কেবল সাংগঠনিক ইতিবৃত্তে দেখা যায় সংগঠনটির প্রতিটি সৃষ্টিতে বাংলার ঐতিহ্যের ছোঁয়া। তাদের প্রতিষ্ঠিত ধর্মরাজিকা মহাবিহারের নাম হাসির ছলে দেননি। ঢাকার ধামরাইয়ে পাওয়া গিয়েছিল অশোকের প্রতিষ্ঠিত ধর্মরাজিক স্তম্ভ। সেই স্তম্ভ ও অশোকের ধর্মপ্রচারকে সজীব রাখতেই ঢাকার বুকের প্রথম বিহারটির নাম করণ করা হয় ধর্মরাজিক বিহার। মহাস্থবির বিশুদ্ধানন্দ মহোদয়ই জানেন কতবেলা না খেয়ে, উদ্বাস্তুর মত কতটা পথ ঘুরে, রামকৃষ্ণ মিশনে কত রাত কাটিয়ে এই বিহারের গোড়া করেন।অবাক লাগে, নিকায়গত বিদ্বেষের জন্য যখন অন্য কোন ভিক্ষুই তাঁর এই ত্যাগকে অসম্মান জানান!!!
আরো অবাক করার বিষয় হলো তিনি আজকে নন্দনকানন বিহারের অধ্যক্ষপদ লাভের সুযোগ পেয়েও ক্ষান্তির উদাহরণ স্থাপন করে প্রচার সংঘের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের বুকে প্রতিষ্ঠা করেন নবপণ্ডিত বিহার। বেদনার বিষয় হলো, এই একবিংশ শতাব্দীর ভিক্ষুরা স্ব স্ব নামে যে সমস্ত বিহার প্রতিষ্ঠা করছেন তা মহাস্থবির বিশুদ্ধানন্দ চায়লেই সত্তুর-আশির দশকে করতে পারতেন অথচ তিনি চর্যাপদ ও চট্টল বৌদ্ধদের প্রাণের স্পন্দনকে পুনর্গঠনের জন্য পণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে নাম দিলেন নব পণ্ডিত বিহার।
নন্দনকাননের বর্তমান সমস্যাটি একদিনের নয়। চট্টল বৌদ্ধ সমিতি থেকে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতিও একদিনে হয়নি। যখন নিকায়গত কোন সংগঠনের স্মৃতিচিহ্ন ছিল না তখনই তদানীন্তন নেতৃত্বের কোন্দলে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ মহাসভা ও চট্টগ্রাম বৌদ্ধ সমিতির বহু উত্থান-পতনের আবর্তে আজকের বৌদ্ধ সমিতি ও নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহার।
কৃষ্টি প্রচারের সত্তুরের নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ দশ বছরের ভাঙ্গন তাদের পথচলার কলঙ্কিত অধ্যায়। কিন্তু কলঙ্ককে কীভাবে সৌষ্ঠবে রূপান্তর করতে হয় তা মহাস্থবির বিশুদ্ধানন্দ, মহাস্থবির প্রিয়ানন্দ,মহাস্থবির জ্যোতিঃপাল মহোদয়কে না দেখলে বৌদ্ধ সমাজ শিখতে পারতো না। আপাতত সংশ্লিষ্ট গৃহীদের অবদান তুলে ধরলাম না। ভেঙেও মিশতে পারার ক্ষমতা কৃষ্টিই রেখেছে। দীর্ঘ পথচলায় মাননীয় সঙ্ঘনায়ক ধর্মদর্শী মহাস্থবির, মাননীয় মহাসঙ্ঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির, মাননীয় সঙ্ঘরাজ জ্যোতিঃপাল মহাস্থবির, মাননীয় সঙ্ঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাস্থবিরের অন্তর্ধানে সে আসনে আসীন আছেন মাননীয় বুদ্ধপ্রিয় মহাস্থবির মহোদয়।
নেতৃত্বের খরা কৃষ্টিতে খুব একটা আসেনি তবে নতুন নেতৃত্বের দীনতা হয়তো আমার ক্ষীণদৃষ্টিতেই প্রতীয়মান। এবারের পুনর্গঠনে কৃষ্টি প্রচার সঙ্ঘে বেশ তারুণ্যের উপস্থিতি লক্ষণীয়। বিশেষ করে যুব শাখায় অকুতোভয় দানবীর প্রমথ বড়ুয়ার পুত্র ব্রহ্মাণ্ড প্রতাপ বড়ুয়া (তাঁর নিজস্ব পরিচয় আছে) ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী অমরেশ বড়ুয়ার উপস্থিতি বেশ আলোড়িত করলো। কেন্দ্রীয় কমিটির পরিবর্তনে আমাদের সংবেদনশীলতা ও দায়বদ্ধতা—দুটোই রয়েছে। মানুষের আয়ু অত্যন্ত নিন্মগামী। যৌবনের প্রথম স্বপ্নের মত বহু যুবক এই স্বজাতিক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল। তাঁদের মধ্যে বহুজনই কালান্তর হয়েছে পরম না পাওয়ায়। যদিও সাংগঠনিক নীতি নিয়মের প্রতি আমরা অবনত তবু নেতৃত্ব পরিবর্তন বাঞ্চনীয়। নতুনের তরে ছাড়িতে হবে এই আসন—এই মনোবৃত্তি মানেই আসীন ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা নয় বরং তাঁকেও কিছুটা ব্যক্তিক অবসর দেওয়া উচিত। সৃষ্টিশীল নেতৃত্বের প্রতি এই ত্যাগ টুকু সাংগঠনিক সৌন্দর্যবোধ। এখানে সামনের সারির বহু নেতৃত্বের সহধর্মিণীরাই জানে কৃষ্টি প্রচার পাগল স্বামীটি কতবার ভুলেছে বাজার-সদাইয়ের কথা, কতবার অসুস্থ সন্তানকে তার কাছে রেখে ছুটেছে প্রচার সঙ্ঘের কাছে। সেই সহধর্মী হেঁসেলই জানে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে কতবার অতিথিদের বেড়ে দিতে হয়েছে নিজেদের জন্য রন্ধনকৃত ভাত। যাকগে সেসব, আমাদের দেখা সাংগঠনিক জীবনের অন্তর্লোকে বেড়ে উঠে অদেখা আরেকটি জীবন যা কেবল সংগঠকের একান্ত। আমরা তাঁর ফরমাল পোষাক দেখি দেখি না দীর্ঘক্ষণ এভাবে বিচরণ করার কষ্টটুকু। কৃষ্টি নামক সাময়িকীটি এখনো প্রচারিত হয়। পুরোনো সংখ্যায় চোখ বুলালে আহত হই, কতটা পিছিয়ে পড়েছি আমরা….
চট্টগ্রাম অঞ্চল ও নারী শাখায় অনেক পরিবর্তন করেছেন। তবে নারী শাখাকে আরো তৃণমূল পর্যায়ে আনা উচিত। আমাদের বৌদ্ধ নারীদের উন্মেষ আজকের নয় তবু স্বীকার করতে হবে যে, তাদের সাংগঠনিক জীবশৈলীর পূর্ণতা দিয়েছে কৃষ্টি প্রচার সঙ্ঘ। বৌদ্ধ মহিলা সমিতি কিংবা বৌদ্ধ সমিতি মহিলা শাখার ক্ষেত্রেও এই জাগরণী বার্তা খাটে।
দিনশেষে দায়বদ্ধতার জায়গায় আমরা যেন পিছিয়ে না পড়ি। সভা-সমিতিতে বসে থাকার মর্ম সবাই বুঝে না। তারা কেবল সংগঠকের বাহ্যিক সৌন্দর্যবোধেই সমালোচন রচনা করে।
সবাইকে অভিনন্দন ও মৈত্রী জ্ঞাপন করছি। তবে বরাবরের সরস্বতী পূজা ছেড়ে লক্ষীপূজায় যেন মনোবৃত্তি আর অবিবৃিদ্ধ করা না হয় সে বিষয়েও আমাদের ভাবতে হবে। বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের যাত্রা অসমাপ্ত হোক…