শুক্রবার,২৩শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বিনোদনময় জীবনের একটি নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ—— ফারজানা আফরোজ

বিনোদনময় জীবনের একটি নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ 

ফারজানা আফরোজ

 যিনি স্বপ্ন দেখেন,স্বপ্ন দেখান
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বিখ্যাত উক্তি

-মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়
-এ পৃথিবীর একটি কণাও তো নৈরাশ্য দিয়ে তৈরি নয়।তাহলে কেন নৈরাশ্য?কেন নয় আশা?

-কে কতটা শিশু তাঁর উপর
নির্ভর করে সে কতটা কালচার্ড,বার্ধক্য হলো আনকালচার্ড।

-অপ্রয়োজনীয় জিনিস সুন্দর হয়,প্রয়োজনের জিনিস গাড়লের মতো হয়।

যিনি এত সুন্দর সুন্দর কথা আমাদের শিখিয়েছেন তিনি হলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।তাঁর এই উক্তিগুলো যেমন আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়,তেমনি আমাদের পথচলায় পাথেয় হিসেবে কাজ করে।তিনি আরো অসংখ্য সুন্দর উক্তির সৃষ্টি করে গেছেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (জন্ম ২৫ জুলাই ১৯৩৯)।বাংলাদেশের একজন শিক্ষাবিদ,সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক।তিনি ষাটের দশকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে পরিচিতি পান।সে সময়ে সমালোচক, একজন সাহিত্য সম্পাদক হিসাবেও তিনি অবদান রেখেছিলেন।তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র,যা চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশে আলোকিত মানুষ তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে।২০০৪ সালে তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন।

জন্ম:-২৫ জুলাই ১৯৩৯ (বয়স৮৪)
পার্ক সার্কাস,কলকাতা,পশ্চিমবঙ্গ,ব্রিটিশ ভারত
পেশা:-কবি ও লেখক,শিক্ষাবিদ,সমাজ সংগঠক,টিভি উপস্থাপক।
জাতীয়তা:-বাংলাদেশী
নাগরিকত্ব:-বাংলাদেশ

তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে।তাঁর পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন কলেজ শিক্ষক।মায়ের নাম করিমুন্নেসা।তিনি ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে তৃতীয়।

উল্লেখযোগ্য রচনাবলি:-বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
উল্লখযোগ্য পুরস্কার:-একুশে পদক,রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার,বাংলা একাডেমী পুরস্কার।

বাংলাদেশে অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০৫ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।প্রবন্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।১৯৭০ এর দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন।তাঁর জীবনীমূলক গ্রন্থ ‘বহে জলবতী ধারায়’ অবশ্য তিনি লিখেছেন, ছোটবেলায় তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন,খেলোয়াড় হতে চেয়েছিলেন,দার্শনিক হতে চেয়েছিলেন,এমনকি হতে চেয়েছিলেন গুন্ডা।

কর্মজীবন:
আবু সায়ীদ ১৯৬১ সালে মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন।পরবর্তীতে তিনি কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন।১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল তিনি রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকুরিজীবন শুরু করেন।সেখানে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে যোগ দেন(বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ)।এই কলেজে তিনি দু’বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ্যের দায়িত্ব পালন করেন।এ সময় তার বয়স ছিল মাত্র তেইশ।এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বাংলা পড়াতেন।

এরপর তিনি ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে সেখানে যোগদান করেন।আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান।

ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন হয়,তিনি ছিলেন তার নেতৃত্বে।সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর সম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্য যাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে সংহত ও বেগবান করে রেখেছিলেন এক দশক ধরে।এ সময় কিছুকাল বাংলাদেশ টেলিভিশনে উপস্থাপনাও করেন।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র:-আবু সায়ীদ১৯৭৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে সায়ীদ বলেন,দেশের এই সার্বিক অবক্ষয় এবং সম্ভাবনাহীনতার ভেতর সীমিত সংখ্যায় হলেও যাতে শিক্ষিত ও উচ্চমূল্যবোধসম্পন্ন আত্মোৎসর্গিত এবং পরিপূর্ণ মানুষ বিকশিত হওয়ার পরিবেশ উপহার দেয়া যায়,সেই উদ্দেশ্যে নিয়েই আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি।একজন মানুষ যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অধ্যয়ন,মূল্যবোধের চর্চা এবং মানবসভ্যতার যা কিছু শ্রেয় ও মহান তার ভেতর দিয়ে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠতে পারে।আমরা এখানে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই।কাজেই আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি একটি প্রাণহীন,কৃত্রিম, গতানুগতিক প্রতিষ্ঠান নয়,এটি একটি সর্বাঙ্গীন জীবন পরিবেশ।

সাহিত্য:-আবু সায়ীদ ১৯৬০-এর দশকে বেশ কিছু প্রবন্ধ,উপন্যাস ও কবিতা লিখেছেন।তাছাড়া ওনার বক্তব্য সংবলিত গ্রন্থ ব্রাহ্মনের বাড়ির কাকাতুয়া অতি বিখ্যাত।আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি।আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে এবং একইসাথে ‘কণ্ঠস্বর’ নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন এ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান।শুধু তাই নয়,দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’,যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে।আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে।আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘ভাঙো দুর্দশার চক্র’,’আমার বোকা শৈশব’,’নদী ও চাষীর গল্প’,’ওড়াউড়ির দিন’,’অন্তরঙ্গ আলাপ’,’স্বপ্নের সমান বড়’,’উপদেশের কবিতা’,’অপ্রস্তুত কলাম’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করেছে।

পুরস্কার ও বই:-
#২০০৪-রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার
#২০০৫-শিক্ষায় অবদানের জন্য একুশে পদক
#২০১২-প্রবন্ধে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার
#২০১৭:-বাংলাদেশ লাং ফাউন্ডেশন থেকে পালমোকন-১৭ সম্মাননা (৭)

স্মৃতিচারনা:-কবি ও সাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে।পণ
করেছিলেন লেখক হবেন।প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার সাক্ষী তিনি।এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারনা করবেন।এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।

লেখকদের নিয়ে যত ঘটনা-২১
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে আমরা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি নি।একই মানুষ যখন অনেক কাজ করেন,তখন আমরা আর তাঁকে ঠিকঠাকভাবে চিনে উঠতে পারি না।অনেকটা হাত দেখার মতো করে তাঁকে বিচার করার চেষ্টা করি।সায়ীদ স্যারের অনেকগুলো বই আমাকে পড়তে হয়েছে।স্যারের সঙ্গে নিউইয়র্ক বইমেলায় গেছি,চট্টগ্রামের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে র অনুষ্ঠানে থেকেছি।তাঁর বিশালত্ব এবং প্রতিভার বহুমূখীনতা আমাকে বারবার মুগ্ধ করেছে।খ্যাতিমান মানুষদের কাছে যেতে নেই।গেলে আপনি তাঁর মানুষি দুর্বলতাগুলো দেখে ফেলে হতাশ হবেন।সায়ীদ স্যারের বেলায় আমার তা ঘটেনি।আমি ২০০৩ সালে প্রথম আলোয় ‘ভালোবাসার সাম্পানের কান্ডারি’ নামে যে লেখা লিখেছিলাম,তা এখনো প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি।সেই লেখাটা নিচে তুলে ধরছি:
‘এইবার!
এইবার আমি আমার উপযুক্ত পথ খুঁজে পেয়েছি।
মান্নান!
যাদের মধ্যে জ্বলছে শিল্পের শিখা,
জিজ্ঞাসার ক্ষুধা আর স্বপ্নের অজস্র আক্রমনের এক জায়গায় গুছিয়ে নিয়ে বসেছি এআার।প্রকৃত স্বচ্ছতা!প্রকৃত শান্তি!প্রকৃত সমীকরণ!কণ্ঠস্বর!টেলিভিশন? লে-খা-লে-খি?শো-ম্যা-ন-শিপ?
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র?-
ওসব অনেক হয়েছে।
তুমি তো জানোই,আমি আসলে নাট্যকার,নাটকের রক্ত বইছে আমার শিরা-উপশিরায়।হ্যা,আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে একটি অলিখিত অসম্ভব নাটকের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে আমি শিরোপা দিতে চাই।

আশা করি,জনাব কবীর চৌধুরী ও জনাব সাঈদ আহমদ অনুমোদন করবেন কবিতাটি।আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখা কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অনেকগুলো পরিচয় এই কবিতায় চমৎকার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

বোকা হোস- এই উক্তি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রিয় কেন?
তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ওপর দেওয়া এক তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় এ সম্পর্কে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।তিনি মনে করেন,নিজের মঙ্গল-অমঙ্গল স্বার্থ চিন্তা না করে অন্যের উন্নতির জন্য যাঁরা আত্মোৎসর্গ করেন,সমাজের আর দশজন সাধারণ মানুষের চোখে তাঁরা বিবেচিত হন বোকা বলে।এ ধরনের বোকা মানুষেরাই যুগে যুগে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এ রকমেরই এক বোকা মানুষ।আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর চাকরিজীবনে পদোন্নতি,বৈষয়িক উন্নতির চেষ্টা করেননি।পড়িয়ে গেছেন।তা-ও বোধ করি বোকার মতোই।এরকমই অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email