
বিভীষিকাময় ২১শে আগস্ট
বিশ্বজিত বড়ুয়া
আগস্ট মাস যেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের জন্য এক বিভীষিকাময় মাস। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে দেশে না থাকার কারণে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৪ সালের ১৫ই আগস্ট শনিবার ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক জনসভায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দ্যেশে গ্রেনেড হামলা করা হয়। শুধু গ্রেনেড হামলা নয়, এই গ্রেনেড হামলা ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রথম পরিকল্পনা, যদি প্রথম পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হয়, তবে দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল অভিজ্ঞ স্যুটারের দ্বারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। শেখ হাসিনা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। সেখানে একটি ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চে তিনি কুড়ি মিনিট ভাষণ শেষ করে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দেন। তারপর মঞ্চ থেকে ধীরে ধীরে নামতে থাকেন। হঠাৎ শেখ হাসিনার পরিচিত এক ফটো সাংবাদিক শেখ হাসিনাকে ফটো তোলার জন্য দাঁড়াতে বলেন, তিনি হাসি দিয়ে একটু অপেক্ষা করেন, এই একটু সময় হলো শেখ হাসিনার জীবনের মহামূল্যবান সময়, শেখ হাসিনা না দাঁড়ালে প্রথম গ্রেনেডের আঘাত প্রাপ্ত হতেন প্রথমেই তিনি। দ্বিতীয় পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়, প্রথম গুলি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বডিগার্ড ধারণ করার কারণে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, গুলি খাওয়ার পরও বডিগার্ড ধাক্কা দিয়ে শেখ হাসিনাকে গাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দেন। বডিগার্ডের রক্তে শেখ হাসিনার শাড়ী লাল হয়ে যায়। এর পর পর গাড়িকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়, প্রতিটি গুলির টার্গেট ছিল ঠিক শেখ হাসিনার মাথা বরাবর বুলেট প্রুফ গাড়ি বলে সেদিন শেখ হাসিনা বেঁচে গিয়েছিলেন। কত দূর থেকে এই গুলিগুলো ছোড়া হয়েছিল, তাদের প্রতিটি নিশানা একদম শেখ হাসিনার মাথা বরাবর। তারপর সেদিন সেখানে অবস্থানরত পুলিশ টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে পুরো এলাকাকে ধোঁয়াময় করে যেন যারা গুলি ছুঁড়ে ছিলো তাদেরকে নিরাপদে চলে যেতে সুযোগ করে দিল। পরে সেখান থেকে গ্রেনেড হামলার আলামতও সরিয়ে ফেলা হয়।
কথায় আছে, রাখে আল্লাহ্, মারে কে? প্রশ্ন আসে যারা গ্রেনেড ছুঁড়ে ছিল তাদের অবস্থান কোথায় কোথায় ছিল, তারপরে যারা গুলি ছুঁড়ে ছিলো তাদের অবস্থান কোথায় ছিলো? এবং তারা কারা? সেদিন যদি শীর্ষস্থানীয় নেতারা মানব প্রাচীর গড়ে না তুলতো তাহলে শেখ হাসিনার কী অবস্থা হতো? মাত্র দেড় মিনিটে ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়, আরো অনেক গ্রেনেড অবিস্ফোরিত ছিল। ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হয়। এই হামলায় আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী মিসেস আইভি রহমান অন্যতম, যিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী। তাছাড়া শেখ হাসিনাসহ ৩০০ মানুষ আহত হয়। আহতদের মধ্যে এখনো অনেক মানুষ ঘাতক গ্রেনেডের স্ফিন্টার দেহে বহন করে দুর্ভিসহ জীবন যাপন করছেন।

ওই ঘটনায় হত্যা, হত্যা চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, ঘটনায় সহায়তাসহ বিভিন্ন অভিযোগে একটি মামলা হয়, এতে মোট ৫২ জনকে আসামি করা হয়। অন্য একটি মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় বর্তমান আসামির সংখ্যা ৪৯ জন। একই ঘটনায় ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আইনে (সংশোধনী-২০০২) অপর একটি মামলায় আসামি সংখ্যা ৩৮জন।
তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল চারদলীয় জোট সরকার তথা বি এন পি সরকার। এ ঘটনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক জিয়া, চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৫২ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে অন্য মামলায় মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড হওয়ায়, তিনজন ছাড়াই বিচারিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
মামলায় মোট আসামি ৪৯ জন, এর মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ৩১জন, এবং তারেক রহমানসহ ১৮জন আসামি পলাতক রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন ২২৫ জন মানুষ। অন্যদিকে, আসামি পক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন ২০ জন।
মামলা দুটির বিচারকাজ এ বছরের ১৮ই সেপ্টেম্বর বিচারিক আদালতে শেষ হয়েছে।
গ্রেনেড হামলার দায় বি এন পি সরকার কোনো ভাবেই এড়াতে পারে না, কিন্তু বি এন পি সরকার জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল এবং তা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গ্রেনেড হামলাকারীরা এখন আত্মগোপনে গেলেও সুযোগ পেলেই তারা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে।