
নিগূঢ় বেদনা বুকে টুঙ্গিপাড়া
––—–মাহবুবা চৌধুরী
সময়ের তীক্ষ্ণ তীর আমাদের দিকে তাক করা তবুও মাঝে মাঝে জুটে যায় কিছু দুর্লভ সুযোগ। দুপাশের রাস্তার মলিন ধুলোকে উড়িয়ে দিয়ে মন ছুটে যায় দূরে জানা অজানায় বহুদূরে।এবার ঢাকায় তেমনি কিছু দূর্লভ মুহূর্ত এসে ধরা দিলো এক্কেবারে অযাতিত ভাবে। আর বুকের ভিতর লালিত কিছু বাসনা বাস্তব হয়ে ধরা দিলো। আমার ছেলে ছেলেবউ আর ওদের বাবা একটা সম্পূর্ণ দিন দিয়ে দিলো আমার করে ওদের শত ব্যস্ততাকে একপাশে রেখে।একটু সুযোগ পেয়েই সবাই ছুটে গেয়েছিলাম গোপালগঞ্জের মধুমতী নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে যেখানে পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুনের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেস ওয়েতে স্বল্প সময়ে পৌঁছে গেলাম মাওয়া। এরপর পদ্মা নদীর কলকল ছলছল জলের ওপর নব নির্মিত প্রথম দেখা পদ্মা বহুমুখী সেতু পেড়িয়ে এসে পড়লাম বঙ্গবন্ধু মহাসড়কে। দৃষ্টিনন্দন এই এক্সপ্রেস ওয়েটির ওপর দিয়ে চলতে চলতে মনে হলো যেন অন্য কোন দেশে এসে পৌঁছেছি। পঞ্চাশ বছরের স্বদেশটির মানচিত্রের এই আমূল পরিবর্তন বুক জুড়ে শ্বাস জুড়ে চক্ষু জুড়ে অবলোকন করে মোহিত হলাম গর্বিত হলাম ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক বা ঢাকা–ভাঙ্গা ছয় লেইনের
এক্সপ্রেসওয়ে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম জাতীয় এক্সপ্রেসওয়ে। এটি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ দ্বারা পরিচালিত। এটি এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এএইচ১-এর একটি অংশ। এই ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়েতে দুটি সার্ভিস লেন, ৫টি ফ্লাইওভার, ১৯টি আন্ডারপাস, ২টি ইন্টারচেঞ্জ, চারটি রেলওয়ে ওভার ব্রিজ, ৪টি বড় সেতু, ২৫টি ছোট সেতু এবং ৫৪টি কালভার্ট রয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ হওয়ায় পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়ের দুপাশ সংযুক্ত করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ হয়ে আমরা যাব টুঙ্গিপাড়া।
গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গীপাড়া গ্রাম। এখানেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাদপুরুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধটি রয়েছে গভীর বেদনাকে বুকে নিয়ে।
দ্রুত গতিতে কোনরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই চলেছে গাড়ি। এটি ছিলো সকাল দশটার দিকে। টুঙ্গিপাড়া পৌঁছালাম তখন দুপুর এক’টা। লাঞ্চ ও নামাজ শেষে এক নম্বর গেইট দিয়ে ঢুকে পড়লাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধ প্রাঙ্গনে।
পাশেই দেয়াল জুড়ে লেখা সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদ এর একটি কবিতা যার শুরুটা” দাঁড়াও পথিক বর”। যথার্থ বাংগালী, যদি তুমি হও ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধি স্থলে।
দাঁড়িয়ে পড়লাম। বুক চিড়ে প্রচন্ড বেগে বেড়িয়ে আসছিলো এক সাগর উদ্বেলিত সুনামির জলোচ্ছ্বাস। আমরা ভেসে গেলাম সেই জলোচ্ছ্বাসে অশ্রুজলে।
“একটি অমর সমাধি“
সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদ
“দাঁড়াও পথিক বর”। যথার্থ বাংগালী, যদি তুমি হও
ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধি স্থলে।এখানে ঘুমিয়ে আছে, বাংগালীর সর্বশ্রেষ্ট নেতাএদেশের মুক্তি দাতা, বাংলার নয়নের মণি।শত দুঃখ জ্বলা স’য়ে, জীবনের বিনিময়ে যিনি বাংগালীর দিয়ে গেছে স্থান, বিশ্বের দুয়ারে।বিনিময়ে দিয়েছে আত্নাহুতি, তার পূন্যময়ী সতী
নিস্পাপ কনিষ্ট সন্তান, পিতার আদুরে “রাসেল”,
স্নেহের পরশ পেতে, সর্বদা ছিল যে তার পিতার কাছে কাছে ঘেঁষে।নবপরিণীতা পুত্র বধু দু’টি, হায়; কেহই তো পায়নি রেহাই উম্মাদের নির্মম বুলেট হতে হতভাগ্য বাংগালী আজ তাই, অভিশপ্ত জাতি।সুতরাং মুখ ঢাকো, মুখ ঢাকো তুমি।এ আমার প্রলাপ নহে, এ আমার পাপের জ্বালা।এ আমার অন্তরের ব্যাথা।
তাই, হে পথিক বর! আরো একটু দাঁড়িয়ে যাও।
হেথা পূণ্য ভূমে,”বাংগালী তীর্থ ভূমি”, টুংগীপাড়া গ্রামে।জীবনে কখনও যে একদন্ড তরে লভেনি বিশ্রাম
আজ সে, গহন মাটির গোরে, তাঁরই শান্তির নীড়ে
যেন করিছে আরাম।পার্শ্বে শায়িতা আছে স্নেহময়ী মাতা, আরো আছে পূণ্যবান পিতা।কৃতজ্ঞ জাতি। কী আর কহিব তোরেজীবনে তো নিয়েছিস শুধু, প্রতিদানে কিছুই কিদেবার নেই তোর। যদি থাকে হে পথিক! তবপরে মোর মাত্র একটি অনুরোধ–তোমার হাতের ঐ–“ফুল মালা” হ’তেঅন্তত একটি “পাপড়ি”, আর একবিন্দু “অশ্রুজল”ফেলে যেও ধীরে– অবশ্য ক’রে এই সমাধি স্থলেআর এমনি করেই “তার কাছে সমগ্র জাতির ঋণ”শুধরাতে হবে পলে পলে।আমার বিশ্বাস। এরই মধ্য দিয়ে বাংগালীর ঘুচিবে অভিশাপ,আসিবে সুদিন।১৪ই জুন, ১৯৮৪
দুচোখে জল নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সম্মুখে বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ।খুব বিশাল না হলেও সমাধি কমপ্লেক্সটি ৩৮.৩০ একর জমির উপর অবস্থিত বলে জানা গেলো।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গীপাড়া গ্রামে এই এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। এই টুঙ্গিপাড়ার মাটিজলে হেসে খেলে বড় হয়েছেন তিনি। এখনো মধুমতী নদীর জলে শিশু মজিবুর রহমানে কথা শব্দের প্রতিধ্বনি কান পাতলেই বুঝি শোনা যায়। স্মৃতি বিজড়িত জরাজীর্ণ বাড়িখানা এখনো দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে সেই সব সুখময় স্মৃতি আগলে।১৯৭৫ সালে কিছু বিপদগামী বাঙালি ঘাতকের হাতে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে ওনাকে টুঙ্গিপাড়ায় সমাহিত করা হয়েছিল। বহু বছর ধরে অযত্নে পড়ে ছিলো এই সমাধিস্থল। এখানে প্রবেশও সীমিত ছিলো ।১৯৯৬ এর জুন মাসে আওয়ামী লীগের সরকার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শুরু করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ মার্চ সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এই সমাধিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বাইগার নদীর পাড়ে প্রায় ৩৯ একর জমির উপর বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধটি নির্মিত হলে
২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সমাধিসৌধের উদ্বোধন করেন।কমপ্লেক্সের সামনের উদ্যান পেরিয়ে গেলেই বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ চোখে পড়ে। লাল সিরামিকের ইট এবং সাদা-কালো টাইলস যেন হয়ে উঠেছে বিমূর্ত বেদনার প্রতীক।সমাধিসৌধের উপরে সাদা পাথরের তৈরী গোলাকার একটি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজের দেয়াল জাফরি কাটা, আর এই জাফরি কাটা অংশ দিয়েই সমাধিস্থলে সূর্যের আলো প্রবেশ করে কাচের কারুকাজের মধ্য দিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
খালি পায়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই বিনম্র শ্রদ্ধায় নত হলো মস্তক। পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলাম সবুজ ঘাসের মাঝে সাদা পাথরের দেয়াল ঘেরা চিরশান্তিতে শায়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধি। আর বুকের ভিতর সুনামিটা আর একবার সজোড়ে আঘাত হানলো।
পাশে আরও দুটি সমাধির একটিতে বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং অন্যটিতে মাতা সায়েরা খাতুন।
আর এই তিনটি কবরকে ঘিরেই মূল টম্ব নির্মাণ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের মধ্যে আরও রয়েছে মসজিদ, পাঠাগার, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনী কেন্দ্র, জাদুঘর ক্যাফেটেরিয়া, বকুলতলা চত্বর, উন্মুক্ত মঞ্চ, স্যুভেনির কর্নার, ফুলের বাগান এবং কৃত্রিম পাহাড়।
জাদুঘরের পাশে গ্রন্থাগারটি ৬০০০ গ্রন্থে সম্মৃদ্ধ রয়েছে।
প্রদর্শনী কেন্দ্রে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের দূর্লভ কিছু ছবি ও কিছু ঐতিহাসিক সংবাদপত্র ।
এছাড়াও রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের পৈত্রিক বসতবাড়ি এবং ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত শেখ পরিবারের একটি মসজিদ।রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানেরস্মৃতি বিজড়িত একটি পুকুর, পারিবারিক বাগান ইত্যাদি।
কমপ্লেক্সটির অনতিদূরে শেখ রাসেলের নামে একটি বিনোদন পার্ক রয়েছে। শিশুদের বিনোদনের উপকরণ বিভিন্ন রাইড দিয়ে নান্দনিকভাবে প্রকৃতির রঙ রূপে সাজানো হয়েছে পার্কটি।পার্কে বসে ফুসকা আর চা খেতে খেতে সেই নন্দনকাননের সবুজ সোভা প্রাণ ভরে উপভোগ করলাম।
ফিরে এলাম তখন গোধূলির ছায়া ধীরে ধীরে রাতের আঁধারে ঢুকে পড়ছে। অন্ধকার রাতে এক্সপ্রেস ওয়েটি আরও বেশি মনোলোভা আকর্ষণীয় মনে হলো। মনে হলো আমার স্বদেশ আমাদের বাংলাদেশ গর্বে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর বুকে।